ল্যুরির সেই কার্টুন বনাম রাশিয়ার তেল-গ্যাস ও পুতিন-দুগিন

দিন বদল বাংলাদেশ ডেস্ক || দিন বদল বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ রাত ১১:২৪, রবিবার, ১৯ জুন, ২০২২, ৫ আষাঢ় ১৪২৯
ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

আশির দশকের মাঝামাঝি শীতল যুদ্ধ তখন চরমে। দুনিয়ার সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সব মাঠে-ময়দানে তখন ইউএসএ বনাম ইউএসএসআর এর দ্বন্দ্ব-দ্বৈরথের নমুনা মেলে। সরাসরি যুদ্ধে, কূটনীতিতে, খেলার মাঠে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের মল্লযুদ্ধ দৃশ্যমান ছিল, এমনকি তার উপস্থিতি ছিল মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রেও। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের এই বাংলাদেশ সৃষ্টির সময়েও এই দুই পক্ষের প্রক্সি ওয়ার চরম রূপ নিয়েছিল। মোটকথা রুশ-মার্কিন প্রতিযোগিতার দ্বৈরথ মহাকাশ অভিযান থেকে নিয়ে মিডিয়ায় খবর ও চিত্র প্রকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

ওই সময়টায় মার্কিনপন্থি পত্রপত্রিকায় আর মিডিয়ায় লুরি’র (রানান আর. লুরি) কার্টুন খুব জনপ্রিয় ছিল। ইসরাইলি-আমেরিকান লুরির রাজনৈতিক কার্টুনগুলো ছিল কমিউনিস্টদের জন্য শরাঘাত স্বরূপ যাতে থাকতো তীব্র উইট সমৃদ্ধ শ্লেষ আর বিদ্রুপাত্মক খোঁচা। ইউরোপ আমেরিকার প্রভাবশালী দৈনিক আর সাময়িকীগুলো ছাড়াও লুরির ওইসব কার্টুন তখন ছাপা হতো দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মার্কিনপন্থি পত্রিকাগুলোয়।

আমাদের দেশে দৈনিক ইত্তেফাকের বদৌলতে লুরির অসাধারণ ওইসব কার্টুনের কিছু কিছু দেখার সুযোগ হতো। রুশ বা কমিউনিস্ট নেতারা যে কোনো বাতচিত বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করতেন তাকে ব্যঙ্গ করে মজাদার সব কার্টুন-আর্টিকেল করে ফেলতো পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক পক্ষ। তাদের মধ্যে সম্মুখ সারিতে থাকতো লুরির কার্টুন।

এমনি একটি ইঙ্গিতবাহী কার্টুনের কথা এখনো মনে পড়ে। এক অনুষ্ঠানে সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ খুব সম্ভবত বলেছিলেন, ৮০ দশকের মধ্যেই রাশিয়ার সব কমরেডের ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার থাকবে। অর্থাৎ দেশটি এতই উন্নতি করবে যে প্রত্যেক নাগরিক অন্তত একটি করে হেলিকপ্টারের অধিকারী হবেন উল্লেখিত সময়ের মধ্যে।

তো সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভের এই বক্তব্যকে ব্যঙ্গ করে ল্যুরি কার্টুন আঁকলেন যাতে দেখা গেল, আকাশে দুটি হেলিকপ্টার মুখোমুখি ভাসমান। উভয় যানের জানালা দিয়ে মুখ বের করে আছেন দুজন চালক।

একজন প্রশ্ন করছেন- কমরেড এত তাড়াহুরো করে কোথায় চললেন? জবাবে অপরজন বলছেন, খবর পেয়েছি বৈকাল হ্রদের পাড়ে কোথায় যেন একজন দুই কেজি চিনি বিক্রি করবে। তাড়াতাড়ি সেখানেই যাচ্ছি, কমরেড! না হয় আবার অন্য কেউ নিয়ে নেবে...

সেই গত শতাব্দীর ৮০ সালের আগে-পরের কথা, তাই সঠিক বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। বলতে পারি কার্টুন এবং এর সংলাপ অনেকটা এরকমই ছিল। আমি তখন স্কুলের ছাত্র, কিছুক্ষণের জন্য দেখেছিলাম কার্টুনটা। তেমন গভীরভাবে আন্তর্জাতিক পলিটিক্সের বিষয়-আশয় বুঝি না, তারপরও হেসে উঠেছিলাম। এই এক কার্টুনে লুরি বলতে চেয়েছিলেন যে, সোভিয়েত রাশিয়া হয়তো নির্দিষ্ট সময়ে তার নাগরিকদের প্রত্যেককে আকাশযান অর্থাৎ হেলিকপ্টার বরাদ্দ দিতে পারবে কিন্তু তাদের নিত্যপণ্যের আক্রা ভয়াবহ রূপ নেবে তখন।

অর্থাৎ হেলিকপ্টারে হাজার হাজার রুবলের তেল খরচা করে দুই কেজি চিনির জন্য হন্যে হয়ে ছুটতে হবে কমরেডদের। খুবই ইঙ্গিতবাহী আর দ্ব্যর্থবোধক মেসেজ বহন করেছিল কার্টুনটি।

ল্যুরির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনটির মর্মকথা কিন্তু বাস্তব রূপ নিয়েছিল। নাগরিকদের প্রত্যেককে হেলিকপ্টার দিতে তো পারেইনি রুশ নেতারা, উল্টো বলশেভিক বিপ্লবের চূড়ান্ত যবনিকা ঘটে যায় পরবর্তী এক দশকের মধ্যেই। কোথায় হেলিকপ্টার আর কোথায়... 

যাহোক, শীতলযুদ্ধের শীতলতম অনুশীলনে পৃথিবীর স্থানে স্থানে প্রবল দুই প্রতিপক্ষের প্রকাশ্য মল্লযুদ্ধ আর পর্দার আড়ালের সুকৌশলী শতরঞ্জ খেলার দানে একপর্যায়ে মাত খেয়ে যায় কমিউনিস্ট রাশিয়া। নানা ঘটনা পরম্পরার শকটে চড়ে চূড়ান্ত সময় উপস্থিত হয় সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক এর বিলুপ্তির। ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস বা বড়দিনের দিন (অবশ্য প্রোটেস্ট্যান্ট মতানুসারী রাশিয়ায় ক্রিসমাস বা বড়দিন পালিত হয় ৭ জানুয়ারি। রাশিয়ার মতো একই নিয়মে ক্রিসমাস উৎসব হয় জর্জিয়া, মিশর, আর্মেনিয়াতেও। তারা গ্রেগরিয়ানের বদলে প্রাচীন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে বড়দিন পালন করে থাকে)।

প্রবল শক্তিধর সোভিয়েত সাম্রাজ্যের রাজধানী মস্কোর ক্রেমলিন প্রাসাদের শিখরে শেষবারের মতো ইউএসএসআর-এর পতাকা উড়তে দেখা যায় ১৯৯১ সালের ওই ২৫ ডিসেম্বর। আমেরিকা-ইউরোপসহ সমগ্র বিশ্ব যখন বড়দিনের উৎসব পালন করছিল তখন রাশিয়ায় এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতবিহ্বল বিষাদগ্রস্ত দিন। প্রতীকি অর্থে যারা কমিউনিস্ট শাসনের অবসান চাইছিলেন এবং যারা তা টিকিয়ে রাখতে চাইছিলেন- উভয়ের জন্যই। কারণ, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দুই বিশ্বমোড়লের একজনের এমন অসহায় পরিণতি হয়তো তার প্রতিপক্ষও আশা করেনি। আর এর পরের একটি দশক রাশিয়ার জন্য ছিল চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের, অভাব, অনটন আর হতাশার।

ইউএসএসআর বিলোপের সময়কালে নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব ঘোষণা করে ইউক্রেন, জর্জিয়া, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, মলদোভা, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান। তবে তারা রাশিয়ার সঙ্গে না থাকলেও কমনওয়েল্থ অব ইনডিপেন্টেন্ট স্টেটস (সিআইএস) এর বন্ধনে সম্পর্কিত থাকার ব্যাপারে একমত হয়। ইউএসএসআর ভুক্ত ১৫টি প্রজাতন্ত্রের মধ্যে ৩টি লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া আগেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। ১৫টি সাবেক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে থেকে যায় শুধু কাজাখস্তান।

তবে স্নায়ূযুদ্ধকালের এক পক্ষ অর্থাৎ প্রবল প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার অধিকারী ইউএসএসআর-এর পরমাণু শক্তির পুরোটাই এবং অন্যান্য প্রধান সামরিক শক্তিমত্তা থেকে যায় কেটে-ছেটে ফেলা রাশিয়ার কব্জায়ই।

বলা যায় সর্বশেষ সোভিয়েত শাসক মিখাইল গর্বাচেভের ৬ বছরের শাসনামলই সোভিয়েত মহাকাব্যের যবনিকাপাত ঘটায়। সোভিয়েত রাশিয়ার বিলোপের পেছনে অনেক কারণ চিহ্নিত করা হয়। তবে এর মধ্যে সমাজতন্ত্রী সমাজে নগদানগদি মোটাদাগে যাকে  ‘ভিলেন’ মানা হয় তিনি হচ্ছেন মিখাইল গর্বাচেভ।

পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে আঁতাত করে তিনি তার গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা সংস্কার কর্মসূচির শিখন্ডীর আড়ালে এই মহাযজ্ঞ আঞ্জাম দিয়েছেলেন- এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তিতর্ক থাকতে পারে। তবে সেসবে বেশি মশগুল না হয়ে শুধু এই কয়েকটি তথ্য মনে রাখলেই এ সংক্রান্ত তর্ক-বিতর্ক অনেক সহজ হয়ে যাবে। তা হচ্ছে, ১৯৮৮ সালে বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিন ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত করে মিখাইল গর্বাচেভকে এবং পরের বছরই একই সাময়িকী তাকে ‘ম্যান অব দ্য ডিকেড’ অর্থাৎ দশকের সেরা ব্যক্তিত্ব ঘোষণা করে। এতেও যদি কারো সন্দেহ সন্দেহ ভাব থাকে তবে তারা স্মরণ করুন- পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন গর্বাচেভ। নোবেল পুরস্কার কারা দেয়, কেন দেয়, এ নিয়ে পর্দার পেছনে গুটি চালাচালি হয় কি না- এখানে সেই প্রশ্ন তুলছি না। আপাতত বাদ দেই সে প্রসঙ্গ।     

এরপর নতুন রাশিয়ার দায়িত্ব পান বরিস ইয়েলৎসিন। তারপর আসেন এখনকার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ভ্লাদিমির পুতিন। বছর দশেক খুবই দুর্দশা আর দুর্দিনে কাটে রাশিয়ার। এরপর ক্রমশ সংকট কাটতে থাকে মূলত তেল ও গ্যাস সম্পদের ওপর ভর করে। এই ক্রান্তিকালটায় দক্ষতা দেখান পুতিন। এখনো রাশিয়ার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে আছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। মাঝখানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত দিমিত্রি মেদভেদেভ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন দেশটির- তবে তিনি ওই সময়টায় পুতিনের পুতুল হিসেবেই ছিলেন এবং পুতিনকে ফের ক্ষমতায় আনার সোপান হিসেবে কাজ করেছিলেন।

এখন ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে যে রাশিয়া বা পুতিনকে আমরা দেখছি তার সূচনা আসলে বেশ আগেই হয়ে গেছে। ট্রাম্প-হিলারির মার্কিন নির্বাচনে একজনের পক্ষে সূক্ষ্ম কারুকার্য ও চালিয়াতির অভিযোগ ওঠার মাধ্যমে রাশিয়ার সামরিক ক্ষেত্র ছাড়াও অন্যান্য কৌশলগত এবং ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতায় শক্তিমত্তার বিষয়টি নজরে আসে।

আফগানিস্তানে মার খাওয়া রাশিয়া পরবর্তীতে প্রবল প্রতিপক্ষ মার্কিনীদের সেখানে গিয়ে নাস্তানাবুদ হতে দেখেছে। ওই সময়টায় সে গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে। এরপর নিজেদের তেল রপ্তানির লাইন ঠিক রাখতে সিরিয়ায় সামরিক শক্তিমত্তা এবং দক্ষতা দেখায় তারা।

এখন বর্তমানে ফিরে আসা যাক। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন সূত্রে দীর্ঘদিন ধরে আরেকটি প্রসঙ্গ বেশ আলোচিত হচ্ছে। তা হচ্ছে- ইউক্রেন আগ্রাসনের মাধ্যমে পুতিন কি আসলে ধর্মযুদ্ধে নেমেছেন? ক্যাথলিক খ্রিস্টান প্রধান পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের পুরনো বিরোধ বৈষম্যকে পুঁজি করে নিজস্ব ধারায় ফের রাশিয়াকে বিশ্ব মোড়লির অংশীদার করতে চাচ্ছেন তিনি- এমন অনেকে বলছেন। এবং এক্ষেত্রে তার দর্শন গুরু বলে মানা হচ্ছে আলেকসান্দর দুগিনকে। বলা হচ্ছে ‘পুতিনের মগজ’ হচ্ছেন এই দুগিন।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রাজনীতি জগতের গবেষকেরা ছাড়া দুগিনের নাম রাশিয়ার বাইরের মানুষ শোনেইনি বলা যায়। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বর্তমানে ৬০ বছর বয়সী আলেকসান্দর দুগিন-ই হচ্ছেন পুতিনের মূল প্রেরণাদাতা। পুতিন যা যা করে যাচ্ছেন, তার মন্ত্রণাদাতা হলেন দুগিন।

দুগিনের লেখা দ্য ফাউন্ডেশন অব জিওপলিটিকস: দ্য জিওপলিটিক্যাল ফিউচার অব রাশিয়া বইটিকে পুতিনের হাতে গড়া আজকের রাশিয়ার ‘মেনিফেস্টো’ হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘ডেইলি বিস্ট’ এর ‘দ্য ফার রাইট বুক এভরি রাশিয়ান জেনারেল রিডস’ শীর্ষক লেখায় বলা হয়েছে, দুগিনের এই বইটি রুশ সেনাবাহিনীর কর্নেল পদমর্যাদার ওপরের সব কর্মকর্তাকে পড়তে হয় বাধ্যতামূলকভাবে।

এই বইটিসহ দ্য ফোর্থ পলিটিক্যাল থিউরি, দ্য গ্রেট অ্যাওকেনিং ভার্সেস দ্য গ্রেট রিসেট, পলিটিক্যাল প্ল্যাটোনিজম: দ্য ফিলোসফি অব পলিটিকস ইত্যাদি বই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয়। এর মধ্য দিয়ে আলেকসান্দর দুগিনের রাজনৈতিক দর্শনকে বর্তমান রুশ প্রজন্মের মগজে রোপণ করে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছে পশ্চিমা জগৎ।

এইসবের পাশাপাশি রাশিয়া বিগত বছরগুলোতে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোকে তার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ওপর এমনভাবে নির্ভর করে ফেলেছে যে এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো অনেক ক্ষেত্রেই অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছে রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগের প্রশ্নে। বর্তমানে ইউরোপের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। পশ্চিম ইউরোপের রুশ নির্ভরতার খতিয়ান আরো আছে। সেটা হচ্ছে- তাদের জ্বালানি তেল আমদানির ২৭ শতাংশ এবং কয়লা আমদানির ৪৬ শতাংশ নির্ভর করে ওই রাশিয়ার ওপরই। তো?

যুক্তরাষ্ট্রের নিজের উৎস থেকে, উত্তর সাগর থেকে এবং কাছাকাছি ও দূরের অন্যান্য উৎস থেকে গ্যাস-তেল এনে রুশ নির্ভরতা কমাতে চাইছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ নিয়ে বৈঠক, শলা-পরামর্শ হচ্ছে। এটা করা গেলে পুতিনকে দুর্বল করা যাবে। যুদ্ধের খরচে লাগাম টানা যাবে। রাশিয়াকে এক ঘরে করা যাবে।

সবই যাবে, কিন্তু কথা হচ্ছে এসব বিষয় বেশ সময় সাপেক্ষ এবং অনেক শর্ত-সম্ভাব্যতার নিগড়ে ঘিরে থাকবে।

রুশ তেল গ্যাস না কেনার সিদ্ধান্ত যতদিনে বাস্তবায়ন হবে ততদিনে ওই রাশিয়া থেকেই বিশাল পরিমাণে তেল-গ্যাস কিনে যেতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে। সেই হিসাব মোতাবেক তেল-গ্যাস-কয়লা কিনতে প্রতিদিন গড়ে রাশিয়াকে ১ বিলিয়ন ইউরো দিতে হচ্ছে বর্তমানে।

অর্থাৎ জ্বালানি বাবদে রাশিয়াকে এক বিলিয়ন ইউরো দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দৈনিক। বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে গত মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেন, অবশ্যই এই অর্থ ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যয় করছে রাশিয়া।

অর্থাৎ অনেক বছর আগে কার্টুনস্ট ল্যুরি হেলিকপ্টার-চিনি আর তেল নিয়ে যে ব্যঙ্গ করেছিলেন, এখানেও সেই তেলই মূল ক্রীড়নক হয়ে দেখা দিয়েছে। ল্যুরির ওই কার্টুনে প্রচ্ছন্নভাবে একটি বিষয় উপস্থিত ছিল যে রাশিয়ার কাছে প্রচুর খনিজ তেল আছে। আর খনিজ তেল যেখানে থাকে সেখানে সাধারণত গ্যাসও থাকে। রাশিয়ার কাছে দুই-ই আছে। এই দুইয়ের জোরে পুতিন তার দর্শনদাতা আলেক্সান্দর দুগিনের মতবাদে বলীয়ান হয়ে অশনি সংকেতময় ভয়াবহ এক কুরুক্ষেত্রের সূচনা হয়তো করে ফেলেছেন ইউক্রেনে। যার থেকে তিনি সজ্ঞানে, সুস্থির মস্তিষ্কে ফিরে যাবেন কি না তা অনিশ্চিত।

অন্যদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো আর ইউরোপীয় ইউনিয়নও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়- এটাও সত্য। এখানে এশীয় শক্তি চীনও বড় একটা নিয়ামক হয়ে দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে একটি তথ্য এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। তা হচ্ছে- চলমান ইউক্রেন সংকটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধের সূত্রে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক আরো মজবুত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়কালে দুদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়।

২০২১ সালে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে মোট ১৪ হাজার ৬৮৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে যা আগের বছরের তুলনায় ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের মধ্যে নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্য ২০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তারা। গত দশকব্যাপী, মস্কো ও বেইজিং বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্কে পরস্পরের পরিপূরক হওয়ার চেষ্টা করছে। ২০১০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে ১৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে বৃদ্ধির হার সর্বাধিক।

সুতরাং, তেমন পরিস্থিতি দেখা দিলে তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা চীন কোনদিকে যাবে তা সহজেই অনুমেয়।

আর এশিয়ার অপর শক্তি ভারত যাকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের ঘনিষ্ঠ মিত্র বানিয়ে ফেলেছে বলে মনে করছিল এতদিন, তারা এখনকার জটিল সময়ে কমদামে রুশ তেল কিনে বাইডেন প্রশাসনের জন্য নয়া চিন্তার দূয়ার খুলে দিয়েছে।

একদিকে, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, শক্তিধর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, প্রশ্নাতীত শক্তিশালী ন্যাটো জোট ও বৃটেনসহ তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আঞ্চলিক জোট ও দেশ। অপরদিকে রাশিয়া, চায়না, ইরান, সিরিয়া... 

মোট কথা, উভয় পক্ষই কৌশল খাটাবে, দুনিয়ার বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিকে নিজের পক্ষে নিতে চেষ্টার কমতি থাকবে না। এবং শেষ তক এক পক্ষের মাত হবে একটা সময়ে এটাও নিশ্চিত। 

তবে সেই কিস্তিমাত যেন পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগে না হয়- আসুন আপাতত আবারও সেই প্রার্থণাটা সেরে নেই মনে মনে।

দিনবদলবিডি/Md. Rahat Hossain

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়