বৃহস্পতিবার বাজেট প্রস্তাবনা: আয়কর দিতে হবে সকলকেই!

দিন বদল বাংলাদেশ ডেস্ক || দিন বদল বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ দুপুর ০২:৫২, সোমবার, ২৯ মে, ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

করোনা মহামারির বিশাল ধাক্কা। মানুষের স্বস্তি ফেরার আগেই শুরু হয়ে গেল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। জোড়া বিপর্যয়ে বিশ্ব যেমন ধুঁকছে, বাদ যায়নি বাংলাদেশও। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে করোনার সময়। এরপর যুদ্ধের ডামাডোলে পড়ে বেড়ে গেল নিত্যপণ্যের দাম। বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে নাভিশ্বাস অবস্থা অনেকের।

এই যখন অবস্থা, তখন স্বস্তির বদলে আরও বড় অস্বস্তি নিয়ে আসছে বাজেট। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট সংসদে পেশ হবে আগামী বৃহস্পতিবার। জানা যাচ্ছে, নির্বাচনের বছর হওয়ার পরও নতুন বাজেটে কর আদায়ে কঠোর হচ্ছে সরকার।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করছাড় কমিয়ে আর বিভিন্ন খাতে করহার বাড়িয়ে জাল এমনভাবে বিছিয়ে দিচ্ছে যে এর রেশ আরেক দফা পড়বে ভোক্তার ঘাড়েই। জানা যাচ্ছে, আয় না থাকলেও দিতে হবে ন্যূনতম আয়কর, সেটাও দিতে দেরি করলে জরিমানা হবে দ্বিগুণ। জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রিতে দ্বিগুণ হারে গেইন ট্যাক্স দেওয়ার বিধান আসছে। মোবাইল ফোনসেট কিনলে যেমন বেশি খরচ করতে হবে, তেমনি বিদেশ থেকে আনা ফ্রিজ, ফ্যান, এলপিজি সিলিন্ডারেও গুনতে হবে অতিরিক্ত শুল্ক। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে কমবে করছাড়, একের বেশি গাড়ির মালিক হলে কার্বন কর দিতে হবে। প্লাস্টিকের বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্যে যেমন খরচ বাড়বে, তেমনি ব্যয়বহুল হবে নির্মাণসামগ্রীও। কারণ, ইট, রড, সিমেন্টেও ভ্যাটের হার বাড়ছে।


এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, কর আদায়ে এমন আরও অনেক বিধান আসছে নতুন অর্থবছরে। বিশ্লেষকেরা জানান, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে যতই কৌশল করা হোক না কেন, বেলা শেষে বাড়তি এই করের বোঝা পড়বে সাধারণ ভোক্তার ঘাড়েই।

জানা যায়, নির্বাচনের বছরে ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার বড় বাজেটে থাকছে খরচের বিশাল বহর। এ খরচ মেটাতে বিভিন্ন খাতে বাড়তি কর বসিয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রীর, যা বাস্তবায়ন করতে অন্তত ৩৬ শতাংশ হারে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হতে হবে। অথচ চলতি অর্থবছরেই ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যপূরণে হিমশিম খাচ্ছে এনবিআর। রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই ১০ শতাংশের ওপরে তোলা যাচ্ছে না।

গবেষণা সংস্থা পিআরআই বলছে, অর্থবছর শেষে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি থাকবে। তারপরও নতুন লক্ষ্যমাত্রায় স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ধরে আরও অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি আদায়ের প্রস্তাব থাকবে বাজেটে। আর এত বিরাট রাজস্ব আয়ের জন্যই এনবিআরের বাড়তি করের ছক।


এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম গতকাল রোববার বলেন, ‘আসলে আয়কর বাড়াতে হবে। সবারই কিছু না কিছু আয়কর দেওয়া উচিত।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আসছে বাজেটে প্রথমবারের মতো আয় না থাকলেও ন্যূনতম ২ হাজার টাকা করের বিধান রাখা হচ্ছে। কেউ যদি কোনো সেবা পাওয়ার জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন, অথচ তাঁর করযোগ্য আয় নেই, তখন এ টাকা কর দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে এটা স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

জানা যায়, অন্তত ৮ লাখ করদাতার করযোগ্য আয় নেই। তাঁদের কাছ থেকে নতুন অর্থবছরে ১৬০ কোটি টাকার বাড়তি কর আদায়ের চিন্তা নতুন বাজেটে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আয় নেই, এটা বলা যাবে না। কিছু না কিছু আয় থাকে।’

নতুন অর্থবছরে দেরিতে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে। তবে এর জন্য দ্বিগুণ হারে জরিমানা দিতে হবে। বর্তমানে দেরিতে রিটার্ন জমা দিলে প্রদেয় করের ২ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়। আসছে অর্থবছরে তা দিতে হবে ৪ শতাংশ হারে।

এ বিষয়ে এনবিআরের আয়কর নীতির সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চাপ কিছুটা হবে। বিশেষ করে যাঁদের আয় নেই, তাঁরা রিটার্ন দিলে ন্যূনতম কর তাঁদের জন্য বোঝা হবে।’

জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির ক্ষেত্রে গেইন ট্যাক্স দ্বিগুণ হচ্ছে। ঢাকায় রাজউক ও চট্টগ্রামের সিডিএর আওতায় জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে গেইন ট্যাক্স ৪ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ করা হচ্ছে। আর দেশের অন্য এলাকার ক্ষেত্রে তা ৩ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ হচ্ছে।

নতুন অর্থবছরে দেশে তৈরি মোবাইল ফোনসেটে খরচ বাড়বে। এসব ফোন তৈরি ও সংযোজনে ভ্যাট আর কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হতে পারে। ভ্যাটের বিদ্যমান হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হতে পারে। কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে।

এলপিজি সিলিন্ডারের খরচও বাড়বে। এলপিজি তৈরির কাঁচামালে শুল্ক বাড়তে পারে, সঙ্গে ভ্যাট। বিদ্যমান শুল্ক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ আর বিদ্যমান ৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হতে পারে। বিদেশ থেকে আমদানি করা ফ্রিজ, ফ্যান ও এস্কেলেটরেও খরচ বাড়বে। এস্কেলেটর তৈরির কাঁচামালের শুল্ক বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব থাকতে পারে বাজেটে। বর্তমানে তা ৬ থেকে ১১ শতাংশ।

পুঁজিবাজারের সেকেন্ডারি মার্কেটসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগে কর রেয়াত কমতে পারে। এতে কিছু সুবিধা হারাতে পারেন বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে করদাতারা তাঁদের করযোগ্য আয়ের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পুঁজিবাজার, ডিপোজিট সঞ্চয় স্কিম (ডিপিএস) ও জীবনবিমায় বিনিয়োগ করে ১৫ শতাংশ কর রেয়াত পেয়ে থাকেন। এটা আসছে অর্থবছরে তুলে দেওয়া হতে পারে।

নতুন অর্থবছরে একের অধিক গাড়ির মালিককে কার্বন কর দিতে হতে পারে। পরিবেশদূষণ এবং যানজট ঠেকাতে এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের কর আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার। এ করের পরিমাণ ২৫ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। গাড়ির ইঞ্জিনক্ষমতা অনুযায়ী করের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।

কোমল পানীয় পান করতে হলে আসছে অর্থবছরে বাড়তি খরচ হবে ভোক্তার। কারণ, নতুন কোমল পানীয় খাতের টার্নওভার কর ৮ গুণ বাড়তে পারে। বিদ্যমান টার্নওভার কর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে। ধূমপায়ীদেরও সিগারেটের পেছনে সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি খরচ হতে পারে। সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্কও বসতে পারে।

নতুন অর্থবছরে ভ্রমণ করেও পরিবর্তন আসতে পারে। ভ্রমণ কর ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব থাকতে পারে। বর্তমানে গন্তব্য বিবেচনায় ৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত ভ্রমণ কর দিতে হয়। এর ফলে উড়োজাহাজে ভ্রমণে ভোক্তার খরচ বাড়তে পারে।

নতুন অর্থবছরে সিমেন্ট, রডসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর খরচ বাড়তে পারে, যা বাড়ি ও ফ্ল্যাটের খরচ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে ২০ টাকা ভ্যাট আরোপ হতে পারে। অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের গৃহস্থালি পণ্যের পেছনে খরচ বাড়তে পারে। আসছে অর্থবছরে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি টেবিল ও রান্নার পাত্র, টিস্যু পেপারসহ বিভিন্ন পণ্যের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হতে পারে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘বৈশ্বিক ব্যাপার রয়েছে। আর্থিক খাতেও নানান বিশৃঙ্খলা চলছে। সে সময়ে বাজেটের কারণে ভোক্তার ওপর স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা চাপ পড়ে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় রাখা একটা কঠিন ব্যাপার।’

দিনবদলবিডি/Rakib

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়