জাকিররা যেভাবে ড্রাইভার হয়, কোরবানরা যেভাবে মারা যায়...

দিন বদল বাংলাদেশ ডেস্ক || দিন বদল বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ রাত ১১:২৬, রবিবার, ১৯ জুন, ২০২২, ৫ আষাঢ় ১৪২৯
র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার বাস মালিক খোকা ও চালক জাকির

র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার বাস মালিক খোকা ও চালক জাকির

পুলিশ কনস্টেবল কোরবান আলীকে হত্যাকারী ঘাতক বাসের চালক ও মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ মোটামুটি বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করতে চাইছি। সংবাদটি হচ্ছে-

‘গত ০৬ জুন সকালে বাংলামোটর এলাকায় বেপরোয়া বাসের চাপায় নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল কোরবান আলী (৩৫)। তিনি মোটরসাইকেলযোগে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ডিউটিতে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক এই মৃত্যুর শিকার হন।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় সড়ক পরিবহণ আইনে একটি মামলা দায়ের করেছে।

সড়কপথে নির্মম যন্ত্রদানবের চাকায় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি মূলধারার মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারিত ও সমালোচিত হয়।

মামলা সূত্রে গত রাতে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নাসিরনগর থেকে মূল আসামি বাসচালক জাকির হোসেন (৪০)কে এবং ঢাকার সাভার এলাকা থেকে বাসমালিক আলম ওরফে খোকা (৩৯) কে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

কোরবান আলী ২০০৫ সালে বাংলাদেশ পুলিশে কনস্টেবল পদে যোগদান করেন। ঘটনার দিন প্রতিদিনের মতো নিজ কর্মস্থল রাজারবাগ পুলিশ টেলিকম-এর উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেলযোগে রওনা দেন এবং পথিমধ্যে এই নির্মম দুর্ঘটনার শিকার হন।

গ্রেফতার বাস চালক জাকিরও ২০০৫ সালে ঢাকায় টেম্পুর হেলপার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ২০১০ সালের দিকে গাজীপুর থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত লেগুনা চালানো শুরু। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ঢাকায় ৭ ও ৮ নং রুটে বাসের হেলপার হিসেবে যোগ দেন।

২০১৮ সাল পর্যন্ত ২টি বাসে হেলপার ও কন্ডাক্টরের কাজ করেন এবং পরবর্তীতে লাব্বাইক ও ওয়েলকাম ট্রান্সপোর্টে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। এযাবত তার যানবাহন চালানোর জন্য কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালে বিআরটিএ থেকে হালকা যানবাহন চালনার লাইসেন্স গ্রহণ করেন তিনি। মাসখানেক আগে বর্তমান মালিকের সঙ্গে পরিচয়। গত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে ওয়েলকাম ট্রান্সপোর্টের ওই বাস মালিকের সঙ্গে দৈনিক ২৫০০ টাকা প্রদানের চুক্তিতে সাভারের জিরানি বাজার থেকে রাজধানীর আরামবাগ রুটে বাস চালানো শুরু করেন। চু্ক্তি মোতাবেক, আড়াই হাজার টাকা মালিককে দেওয়ার পরে অবশিষ্ট টাকা চালক-হেলপার ভাগ করে নিতেন।

ঘটনার দিন জাকির বাস চালিয়ে জিরানি থেকে আরামবাগ যাওয়ার পথে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল থেকে যাত্রী নেন। সেখান থেকে পরবর্তী সিগন্যালে আরো অধিক সংখ্যক যাত্রী নিতে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে থাকেন। এ সময় সামনে থাকা মোটরসাইকেল আরোহী কনস্টেবল কোরবানকে চাপা দিয়ে দ্রুত গতিতে ঘটনানাস্থল ত্যাগ করেন তিনি।

হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বাংলামোটরে গাড়ি রেখে পার্শ্ববর্তী স্থানে লুকিয়ে থাকেন এবং কিছুক্ষণ পর অপর একটি বাসে করে ফার্মগেটে চলে আসেন। বাসে বসে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন তার হেলপারের সঙ্গে। হেলপার জানায়, ভিকটিম সম্ভবত মারা গিয়েছে। পরবর্তীতে বাস মালিককে বিষয়টি অবহিত করেন।

এরপর সারাদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে ঘোরাঘুরি করে রাতে বাসযোগে চট্টগ্রামে চলে যান জাকির। সেখানে দিন কয়েক আত্মগোপনে থেকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় চলে যান। র‌্যাব জানায়, জাকিরের পরিকল্পনা ছিল, অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়া।

অপর আসামি বাসের মালিক আলম ওরফে খোকা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ২০১৭ সালে পরিবহণ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। প্রথমে কিস্তিতে একটি বাস কিনে জিরানি টু মতিঝিল রুটে পরিচালনা করেন। ২০২০ সালে আরেকটি গাড়ি  কিনেন। তবে রুট পারমিট ছাড়াই অবৈধভাবে গাড়িটি চলছিল। পারমিট না থাকা সত্ত্বেও গত ২ বছর ধরে গাড়িটি রাস্তায় চলাচল করছিল।

র‌্যাব জানিয়েছে, গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।’

সংবাদ পরিবেশন শেষ। আমরা আশা করছি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন-আদালত সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অপরাধীদের শাস্তি আর ভিকটিম পরিবারের জন্য সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করবে।

প্রতিবেদনে বাস ড্রাইভার ও মালিকের ঘটনা একটু সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে- অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো মনে হতে পারে তাদের নিয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে লেখার কলেবর বড় করা হয়েছে। তবে এই প্রতিবেদনে বেশকিছু বিষয় আছে যা আমরা নজর এড়িয়ে চলি। অর্থাৎ দেখেও দেখি না। এখানে বয়ান আছে এমন একজন হতদরিদ্র পরিবারের শিশু বা কিশোর বয়সী সদস্যের যে সংসারে অবদান রাখার জন্য টেম্পু হেলপারের কাজ নেয়। কয়েক বছর পর বাসের হেলপারি শুরু করে। এরপর বাস চালনায় হাতেখড়ি। প্রাপ্ত বয়স্কের সীমা পার হওয়ার আগে বা পরে লাইসেন্স ছাড়াই তখন প্রায় বিনা অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণে বাস-ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ড ভ্যান চালাতে শুরু করে জাকিরের মতো ছেলেরা।

মূলত আমাদের সড়ক পথে চলাচলরত যানবাহন সমূহের পেশাদার চালকদের বিরাট একটা অংশই জাকিরের মতো ধারায় হয় টেম্পুর হেলপার, নয় গ্যারেজের ‘পিচ্চি’ বা রেস্টুরেন্টের গ্লাসবয় হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে। খাতা-কলমে শিক্ষা এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এখানে ড্রাইভার খুব একটা তৈরি হয় না। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ গাড়ির জন্য বৈধ চালকের সংখ্যা ২০ লাখেরও কম হবে। বাকি ২০ লাখ গাড়ির চালক কারা এটাও একটি প্রশ্ন বটে! 

গত বছরের জুলাইয়ে স্বয়ং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, ওই বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোট যানবাহনের সংখ্যা ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬২০টি। আর ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক আছেন ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ জন। পর্যাপ্তসংখ্যক ড্রাইভিং স্কুল ও ইনস্ট্রাক্টর না থাকায় প্রয়োজনীয় দক্ষ গাড়িচালক তৈরি হচ্ছে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। মন্ত্রী আরো জানান, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ১২৩টি ড্রাইভিং স্কুলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে এবং ১৭৯ জনকে ড্রাইভিং ইনস্ট্রাক্টর লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এসবের মাধ্যমে দক্ষ ড্রাইভার তৈরি করা হচ্ছে।

অর্থাৎ আমাদের মোট যানবাহনের সংখ্যার (যার সঙ্গে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ নতুন যানবাহন যোগ হচ্ছে) তুলনায় উপযুক্ত প্রশিক্ষিত চালকের সংখ্যা নগণ্য।

গড়পড়তা বিশেষ করে প্রতিদিন সড়ক চলাচলের পথে যেসব নগর পরিবহনে আমরা উঠি সেসবের চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ভীতিকর আর নিয়ম-নীতিহীন কায়দা, ব্যক্তিগত আচরণ যাত্রী সাধারণকে সারাক্ষণ আতঙ্ক আর অস্বস্তির মধ্যে রাখে। এই চালকদের বিশাল অংশটাই জাকিরদের মতো

টেম্পু হেল্পার থেকে চালক হয়ে ওঠা বাস-ট্রাকের চালক যারা আমাদের সড়ক মহাসড়কগুলো শাসন করে। আর তাদের হাতেই প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের বিরাট অংশের প্রাণ যায়। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর বড় কারণ বেপরোয়া গতি। বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই (নিহত কনস্টেবল কোরবানের মতো) গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা।  

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭,৮৫৫ জন নিহত হয়েছেন। আর পরের বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৬ হাজার ৬৮৬ জন, আহতের সংখ্যা ৮ হাজার ৬০০ জন। এসব পরিসংখ্যানে দেওয়া সংখা নিয়ে মত-মতান্তর থাকতে পারে, কিন্তু নির্জলা সত্য হচ্ছে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ সড়কথের দুর্ঘটনায় হত্যাহত হচ্ছে। এছাড়া রেল ও নৌ দুর্ঘটনা তো আছেই।

আমাদের লাখ লাখ যানবাহনের চালকরা জাকিরের মতোই একদিন ওস্তাদকে খুশি করে সুযোগ বুঝে স্টিয়ারিংয়ে বসে গাড়ি চালানোর শিক্ষা নেয়। এখানে ট্রাফিক আইন, রোড সাইন, সিগন্যাল, মানবাধিকার, অন্যের জান-মালের প্রতি সম্মান বা দায়িত্ববোধের শিক্ষা খুব একটা পায়না তারা। অনেক ক্ষেত্রে সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি চালানোর সময় তাদের শুধু ‘গরু-ছাগল’ চিনতে পারার জ্ঞান হলেই চলে বলেও মনে করেন অনেকে। চাকার তলায় জলজ্যান্ত মানুষ ফেলে পিষে এগিয়ে যাওয়ার সময়ে হেলপার জোরে চিৎকার করে বলে, ‘ওস্তাদ ছাগল পড়ছিলো একটা! টাইন্যা যান...’ ঘটনার সময় গাড়ি কিছুটা দুলে ওঠায় যাত্রীরা কিছু ঘটেছে সন্দেহ করলেও হেলপারের ওই ‘ছাগল পড়ছে’ কথায়ই বিশ্বাস রেখে আবার যে যার সিটে ঝিমোতে থাকেন। ঝিমোতে থাকি আমরা সবাইও- যতক্ষণ না ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।

এখন কথা হচ্ছে, আমাদের যারা যে দায়িত্বে আছেন, যারা মাস শেষে নিজের নিজের বেতন-ভাতা-সুবিধা কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেই পাই পাই- সেই মানুষগুলো একটু সত্যিকারার্থে তৎপর হওয়ার সময় আর কবে পাবেন তা একটু ভেবে দেখা যেতে পারে। আমরা জানি, বিভিন্ন দপ্তরে-বিভাগে দায়িত্ববোধের প্রতি নিষ্ঠাবান, সৎ, বিবেকবান, দেশপ্রেমিক অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারি আছেন, তারা আছেন বলেই যেটুকু ভালো এখনো আমরা দেখি, তা ঘটছে। কিন্তু প্রতিটি গ্রুপেই কিছুসংখ্যক বিবেকহীনের জন্য অনেক ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য আমাদের বছরের বদলে যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

জাকির লাইসেন্স ছাড়াই চালাচ্ছিল বাস যার তলায় শেষমেষ নির্মমভাবে মরতে হলো কনস্টেবল কোরবানকে, বাসমালিক খোকা রুট পারমিট ছাড়াই পরিচালনা করছিলেন বাস- রাজধানী জুড়ে, দেশজুড়ে এরকম হাজার হাজার জাকির আছে যারা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা ছাড়াই বিনা লাইসেন্সে সড়কে দাবড়ে বেড়াচ্ছে যন্ত্রদানবে আসীন হয়ে আর পিষে মারছে অনেক পরিবারের স্বপ্ন-নির্ভরতা-আস্থার প্রতীক রোজগেরে মানুষগুলোকে বা কারো ভালোবাসার-স্নেহের প্রিয়জনকে। বাসমালিক খোকার মতো হাজারে হাজারে স্বার্থান্ধ আছেন যারা রুট পারমিটের তোয়াক্কা করেন না, দৈনিক আড়াই হাজার টাকা পেলেই হলো ড্রাইভার-হেলপার থেকে, আর কিছুর দরকার নেই দেখার। পরিবহন যে ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে একটি সেবামূলক পেশাও- এই বুঝ তাদের কে দেবে!

খোকার মতো মালিক আর জাকিরের মতো চালকদের ধরার জন্য ট্রাফিক পুলিশ বা থানা পুলিশকে অপেক্ষা করতে হয় কোনো একটি দুঘটনায় কয়েকজন হতাহত হওয়া পর্যন্ত, বিআরটিএ’র লোকজনও অপেক্ষায় থাকেন এই তথ্য নিশ্চিত করার জন্য যে লাইসেন্সটি ভূয়া ছিল গাড়িটির পারমিট ছিল না। যদি পরিবার ধ্বংসকারী, প্রাণ সংহারক ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো ঘটার আগে এই বিষয়গুলোয় তারা একটু তৎপর হন তবে বেঁচে যায় অনেক কোরবান আলীর প্রাণ, হত্যাকারী হতে হয় না জাকিরদের, খোকার মতো শুধু লোভ-লাভের পায়রা গোনা পরিবহন মালিকরাও এড়াতে পারতেন বিপদ।

মাঝে মাঝে মনে হয়, কিসের কী! কেউ কি শুনবেন এসব কথা? আমরা কি আসলেও ততটা সিরিয়াস, দায়িত্ববান, কর্তব্যনিষ্ঠ হতে পারবো?

দিনবদলবিডি/Md. Rahat Hossain

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়