যে কারণে নবীজি (সা.) আশুরার রোজা রাখার কথা বলেছেন

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বর্ণনায় আশুরার মর্যাদার প্রকৃত ঘটনা

দিন বদল বাংলাদেশ ডেস্ক || দিন বদল বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ বিকাল ০৩:০৪, মঙ্গলবার, ৯ আগস্ট, ২০২২, ২৫ শ্রাবণ ১৪২৯
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের বর্ণনায় ফুটে ওঠেছে আশুরার মর্যাদার প্রকৃত ঘটনা

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের বর্ণনায় ফুটে ওঠেছে আশুরার মর্যাদার প্রকৃত ঘটনা

যুগ যুগ ধরে আশুরা নিয়ে রয়েছে নানা কথা ও ঘটনার বর্ণনা। এ নিয়ে রচিত হয়েছে…

হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ আশুরা অনুষ্ঠিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আজ পবিত্র আশুরা, ১০ মহররম।  এ উপলক্ষ্যে মুসলিম উম্মাহর অনেকে রোজা পালন করেন। কারণ রমজানের পর গুরুত্বপূর্ণ রোজা এটি।

বিশ্ব নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র আশুরার বিশেষ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। কী সেই ঘটনা?

যুগ যুগ ধরে আশুরা নিয়ে রয়েছে নানা কথা ও ঘটনার বর্ণনা। এ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক বই ও ডকুমেন্টরি। যা এখনো হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তবে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। শুধু কারবালার প্রান্তরে হৃদয় বিদারক ঘটনার জন্য আশুরা মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। বরং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের বর্ণনায় ফুটে ওঠেছে আশুরার মর্যাদার প্রকৃত ঘটনা। যে কারণে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার দিনে রোজা রাখার কথা বলেছেন। বেশি বেশি তাওবা-ইসতেগফারের কথা বলেছেন।

সমাজে প্রচলিত আশুরার কিছু ঘটনা

আশুরা নিয়ে সমাজে রয়েছে নানা ধরনের কথা ও ঘটনা। যা মানুষের মাঝে বিভেদ তৈরি করছে। এ সব বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। তাহলো-

১. কেয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়া

অনেকেই বলে থাকেন যে, আশুরার দিনে কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। নির্ভরযোগ্য কোনো বর্ণনায় এ কথা প্রমাণিত নয়। এদিন কেয়ামত সংঘঠিত হোক আর না হোক, কেয়ামত আসার আগেই মুমিন ব্যক্তির উচিত পরকালের প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

২. হজরত আদম আলাইহিস সালামের তাওবা কবুল

আশুরায় তাওবা কবুল হয়। হাদিসে পাকে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা এসেছে। আর আশুরার দিনে হজরত আদম আলাইহিস সালামের তাওবা কবুল হয়েছে মর্মে আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব কিতাবে এ সম্পর্কিত একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তবে ওলামায়ে কেরাম এ হাদিসের সনদকে দুর্বল বলেছেন।

যেহেতু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আশুরার দিন আল্লাহ তাআলা অনেকের তাওবা কবুল করেন। তাই মানুষের উচিত এদিন বেশি বেশি তাওবা করা।

৩. জুদি পাহাড়ে নুহ আলাইহিস সালামের নৌকা নোঙর

আশুরার দিন হজরত নুহ আলাইহিস সালামের নৌকা জুদি পাহাড়ে নোঙর করেছিল বলে শোনা যায়। হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ মুসনাদে আহমাদের একটি বর্ণনায় এ তথ্য পাওয়া যায়। এ হাদিসটিকেও দুর্বল বলা হয়েছে।

৪. হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম

হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম আশুরার দিনে হয়েছে বলে এমনই বর্ণনা এসেছে আত-তারগিব ওয়াত-তারহিবে। আদম আলাইহিস সালামের তাওবার সনদের মতো এ বর্ণনার সনদও দুর্বল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়াও রয়েছে আরো অনেক কথা ও ঘটনা। মূলত এসব কারণে আশুরার মর্যাদা ঘোষিত হয়নি। তবে বনি ইসরাইলের সে ঘটনাটি হাদিসের বর্ণনায় ওঠে এসেছে-

হাদিসে আশুরার সুস্পষ্ট ঘটনার বর্ণনা

আশুরার দিনে দুটি ঘটনা সুস্পষ্ট। তার একটি হলো হজরত মুসা আলাইহিস সালামের কাওমের মুক্তি আর অন্যটি হলো ফেরাউন সম্প্রদায়ের ধ্বংস।

১. হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তার সাথীরা ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সমুদ্রের মধ্যে তাদের জন্য রাস্তা বানিয়ে দেন। যা দিয়ে তারা সমুদ্র পাড়ি দেন।

২. ফেরাউন ও তার বাহিনী মুসা আলাইহিস সালামের কাওমকে তাড়া করে সমুদ্রে তৈরি রাস্তা প্রবেশ করলে সে রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। আর তাতে ডুবে ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়।

৩. এছাড়াও কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ ৭০জন সঙ্গী সাথীর শাহাদতও ঘটে এ আশুরার দিনে। বিশ্বব্যাপী মানুষ এ দিনটিকে যদিও কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি স্মরণ করে থাকে।

মনে রাখতে হবে

মুলতঃ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনা অনুযায়ী আশুরায় নয় বরং মহররম মাসে আমল করার কথা বলেছেন। আর আশুরায় রোজা রাখার কথাও বলেছেণ। হাদিসে এসেছে-

এ মাসে বেশি বেশি নফল রোজা ও তাওবা ইসতেগফারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই মাসব্যাপী আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা মুমিন মুসলমানের জন্য একান্ত আবশ্যক।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি রমজানের পর আরো কোনো মাসে রোজা রাখতে চাও তবে মহররমে রোজা রাখ। কেননা সেটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন রয়েছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা অনেকের তাওবা কবুল করেন। ভবিষ্যতেও আরো অনেক মানুষের তাওবা কবুল করবেন।’ (তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ)।

আশুরা উপলক্ষ্যে শোক পালন, তাজিয়া মিছিল, বিশেষ কোনো নির্ধারিত নামাজ ও নির্ধারিত কোনো দোয়া পড়ায় ইসলামের নির্দেশনা নেই।

তারপরও আশুরা উপলক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি বিশেষ উল্লেখিত রুসুম রেওয়াজগুলো উদযাপন করে থাকেন। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিকোন থেকে কিংবা কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মোতাবেক এসবের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।

তবে আশুরা উপলক্ষ্যে রোজা রাখার ব্যাপারে রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। তাছাড়া রোজা রাখার দিনক্ষণ সম্পর্কেও রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। আর তাহলো-

> আশুরার নফল রোজা মহররম মাসের ১০ তারিখ পালন করা সুন্নত। এদিন রোজা পালনকারীর বিগত বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয় বলে ঘোষণা করেছেন স্বয়ং বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

> সাহাবায়ে কেরাম যখন বিশ্ব নবীকে (সা.) জানালেন যে, ইহুদিরাও এদিন আশুরা উপলক্ষ্যে রোজা পালন করেন। তখন বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, তবে আমরা মহররমের নবমিতেও তথা ৯ তারিখও আমরা রোজা রাখব। সে হিসেবে ৯ ও ১০ মহররম রোজা রাখার নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম।

তবে ইহুদিদের অনুসরণ ও অনুকরণ থেকে নিজের বিরত রাখতে অনেকে নবমিতে রোজা রাখতে না পারলে আশুরার পরের দিন রোজা পালন করে থাকেন। আর তাতে দুইটি রোজা পালন করা হয়।

সেক্ষেত্রে-

> ৯ ও ১০ মহররম রোজা রাখলে হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা পালন হয়ে যায়।

> ৯ তারিখ রোজা রাখতে না পারলে ১০ ও ১১ মহররম রোজা পালনের মাধ্যমে ইহুদিদের অনুসরণ থেকে বিরত থাকা যায়। আর এ কারণে অধিকাংশ ইসলামিক স্কলাররা আশুরার পরের দিন রোজা পালন করাকে বৈধ বলে মত দিয়েছেন। তবে উত্তম হলো ৯ ও ১০ মহররম রোজা পালন করা।

> তবে কেউ কেউ ৯-১১ মহররম এ তিনদিন রোজা পালনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আশুরাসহ মহররম মাস জুড়ে বেশি বেশি তাওবা-ইসতেগফার ও দোয়া করার তাওফিক দান করুন। এবং মুসলিম উম্মাহকে আশুরায় ইবাদত-বন্দেগি মনে করে রুসুম রেওয়াজ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে নিজেদের বিরত রাখার পাশাপাশি হাদিসের নির্দেশনা মোতাবেক রোজা পালন করার তাওফিক দান করুন। 

তাওবা ও ইসতেগফারের জন্য সবচেয়ে উত্তম হলো কোরআন-হাদিসে বর্ণিত ইসতেগফার বিষয়ক দোয়াগুলো বুঝে বুঝে পড়া। এ দোয়াগুলোর মাধ্যমে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দেবেন।

উল্লেখ্য, আজ ৯ আগস্ট ১০ মুহররম। সে হিসেবে আজ মঙ্গলবার ১০ মহররম দিনভর আল্লাহ কাছে তাওবা-ইসতেগফার করা জরুরি। তাহলো-

১. اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ ، وَالإِيمَانِ ، وَالسَّلامَةِ ، وَالإِسْلامِ ، وَرِضْوَانٍ مِنَ الرَّحْمَنِ ، وَجَوَار مِنَ الشَّيْطَانِ

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালঅমাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমানি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি।’ (আল-মুঝাম আল আওসাত)।

২. رَبَّنَا ظَلَمْنَاۤ اَنْفُسَنَا، وَ اِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَ تَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ

উচ্চারণ : রাব্বানা জ্বালামনা আংফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ২৩)।

অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’

৩. أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِي لاَ إلَهَ إلاَّ هُوَ الحَيُّ القَيُّومُ وَأَتُوبُ إلَيْهِ ، رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ، إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الْغَفُورُ

উচ্চারণ : আসতাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম ওয়া আতুবু ইলাইহি; রাব্বিগফিরলি ওয়া তুব আলাইয়্যা, ইন্নাকা আংতাত তাওয়্যাবুল গাফুর।

৪. সাইয়েদুল ইসতেগফার পড়া

أَللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّيْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِيْ وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আংতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আংতা খালাক্বতানি ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়াদিকা মাসতাতাতু আউজুবিকা মিং শাররি মা সানাতু আবুউলাকা বি-নিমাতিকা আলাইয়্যা ওয়া আবুউ বিজান্মি ফাগফিরলি ফা-ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আংতা।’

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আশুরাসহ মহররম মাস জুড়ে বেশি বেশি তাওবা-ইসতেগফার ও দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

দিনবদলবিডি/আরএজে

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়