দেশের বাণিজ্যিক রূপ বদলে দেবে পদ্মা সেতু

দিন বদল বাংলাদেশ ডেস্ক || দিন বদল বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ রাত ০৯:৩৩, শনিবার, ২৫ জুন, ২০২২, ১১ আষাঢ় ১৪২৯
পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু

অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে পদ্মা নদীর বুক চিরে। স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

পদ্মার বুকে জেগে উঠেছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের স্বপ্নের সেতু। সেতু হওয়ায় বদলে যাবে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা। দেশের বাণিজ্য পাবে এক নতুন রূপ। বিশেষ করে যশোর-খুলনা-পটুয়াখালী এলাকার স্থল ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে নতুন এক কর্মচাঞ্চল্য দেখা দেবে। সাধারণ অবকাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়িক কাঠামোতে আসবে বড় রকমের পরিবর্তন।

বাংলাদেশের ১২টি স্থলবন্দরের মধ্যে প্রধান দুটি স্থলবন্দর হচ্ছে বেনাপোল ও ভোমরা। এই দুটি স্থলবন্দর থেকেই দেশের এক-তৃতীয়াংশ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে।

পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেনাপোল ও ভোমরা বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানি হয়েছে ৬৬ লাখ টন পণ্য। একই অর্থবছরে মোট ১২টি স্থলবন্দর থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়েছে ২ কোটি ২ লাখ টন।

পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিবেচনায় ভোমরা-বেনাপোল কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাদ সাধল পদ্মা নদী। নদী পার হয়ে আরিচা কিংবা মাওয়া যেদিক দিয়েই আসা হোক না কেন, প্রায় আড়াই শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। পাড়ি দেওয়া এই পথও সুগম নয়। ফেরির জন্য মাঝেমধ্যে কয়েক দিন পর্যন্ত ঘাটে অপেক্ষা করতে হয়। এতে বেড়ে যায় খরচ, বাণিজ্যিক কার্যক্রম হয় শ্লথ।

একই দশা খুলনার মোংলা ও পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরে। কনটেইনার নিয়ে রাজধানীতে আসতে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ পথ। কিন্তু এবার পদ্মা সেতু বদলে দিচ্ছে সেই চিরাচরিত বাণিজ্যিক রূপ। পদ্মা সেতু হওয়ায় কমে আসবে সময় ও অর্থ দুয়েরই অপচয়। যেখানে ফেরি পাড় হতেই কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যেত, সেখানে কয়েক টন পণ্য নিয়ে ট্রাকগুলো মাত্র ছয় মিনিটে পদ্মা পাড়ি দিতে পারবে।

কেবল বন্দর নয়, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। ঢাকার বাজারের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, দক্ষিণাঞ্চল থেকে সহজে এদিকে সবজি কিংবা অন্য পচনশীল পণ্য আসতে পারে না। এ ক্ষেত্রে রাজধানী শহরকে নির্ভর করতে হয় উত্তরবঙ্গ কিংবা আশপাশের জেলাগুলোর ওপর। অন্যদিকে ব্যাপক ফলনের পরও দক্ষিণাঞ্চলের চাষিরা লাভের মুখ দেখেন না। কিন্তু পদ্মা সেতু হওয়ায় দু-পক্ষেরই সুবিধা হবে। ঢাকার বাজারে কমে আসবে পণ্যের দাম ও সংকট, দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা পাবেন কাঙ্ক্ষিত মুনাফা।

এতে যশোরের সবজি ও ফুল, বরিশালের ধান, ডাব, মুড়ি ও অন্যান্য ফসল, পটুয়াখালীর তরমুজ, ভোলার মাছ, সাতক্ষীরার আম, খুলনার ফসল খুব সহজেই ঢাকার বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। কেবল বাজার নয়, বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটনের চিত্র। বিশেষ করে কুয়াকাটা ও সুন্দরবন পর্যটনখাতে নতুন এক মাত্রা যোগ করতে পারবে। পুরোনো পর্যটনকেন্দ্রের পাশাপাশি সৃষ্টি হবে নতুন পর্যটন আকর্ষণ। বিশেষ করে বরগুনার তালতলী ও পাথরঘাটার সমুদ্র সৈকতগুলো দিনকে দিন পর্যটকদের আকর্ষণে নতুন এক মাত্রা যোগ করতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

পদ্মা সেতু কেন্দ্র করে বদলে গেছে এর আশপাশের এলাকার চিত্র। একসময়ের অনুন্নত শরীয়তপুর দিনকে দিন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, যার মূল উপজীব্য পদ্মা সেতু। বিশেষ করে জাজিরা প্রান্তে শরীয়তপুরে জমির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। কদিন আগেও এ এলাকায় প্রতি বিঘা জমি বিক্রি হয়েছে ২০-২৫ লাখ টাকায়। এখন জমির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। শরীয়তপুর এলাকা ঘিরে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

পদ্মা সেতু কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে নতুন নতুন পরিকল্পনা নিতে শুরু করেছে সরকার। বিশেষ করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু ঘিরে আঞ্চলিক বাণিজ্যকে গুরুত্ব দিয়ে বেনাপোল, ভোমরা ও বুড়িমারী–এই তিনটি স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে ২ হাজার ৯০৬ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকও হয়েছে। শিগগিরই প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাঠানো হবে।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালু হলে বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বাড়বে। বর্তমান সক্ষমতায় ওই দুটি বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালানো কঠিন হবে। বর্তমানে বেনাপোল বন্দরে দৈনিক ৩৭০টি পণ্যবাহী ট্রাক ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আছে। নতুন প্রকল্পের আওতায় আরও এক হাজার ট্রাক ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। একইভাবে ভোমরায় আরও ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ পণ্যবাহী ট্রাক ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো হবে। বেনাপোল বন্দরে ৯০ বিঘা ও ভোমরায় ৬০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সেখানে গুদামঘর, টার্মিনাল, আধুনিক কেমিক্যাল গুদাম, সেবা ভবন ইত্যাদি নির্মাণ করা হবে। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এসব কাজ শেষ করা হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী, পদ্মার ওপারের ২১টি জেলায় ১৩৩টি উপজেলা আছে। এসব উপজেলার মধ্যে ৫৩টি উচ্চ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে ২৯টি বরিশাল বিভাগে। এ ছাড়া ৪২টি উপজেলা মধ্যম দারিদ্র্য এবং ৩৮টি নিম্ন দারিদ্র্য ঝুঁকিতে আছে। রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের পর খুলনা ও বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেশি। এ দুটি বিভাগে দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে সাড়ে ২৭ ও ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুসারে, পদ্মা সেতু হলে এসব অঞ্চলের দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে।

পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, খোদ পদ্মা সেতুই দেশের জিডিপি বাড়াবে ২ শতাংশ, কেবল দক্ষিণাঞ্চলেরই জিডিপি বাড়বে আড়াই শতাংশ। ‘ভালোভাবে হিসাব করা’ একটি টোল হারের মাধ্যমে আগামী ৩৫ বছরের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে সরকার আশা করছে। আশা করা যাচ্ছে, নবনির্মিত পদ্মা সেতুই হবে বাংলাদেশের ডেলটা প্ল্যানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় সোপান।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) এক কর্মকর্তা বলেন, ‘টোলের হার একটি গণনা পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে আগামী ৩৫ বছরের মধ্যে দেশের বৃহত্তম সেতুটির নির্মাণ ব্যয় পুনরুদ্ধার করা যায়।’

দিনবদলবিডি/এইচএআর

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়