বেফাঁস মন্তব্যের গোনাগারি আর ঠান্ডামাথায় দুর্নীতির দায়
দিনবদলবিডি ডেস্ক || দিন বদল বাংলাদেশ
সেবার ঢাকার মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুরো দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর, বিস্ফোরণোম্মুখ। তখনকার…
১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে এক লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে বিএনপির মির্জা আব্বাসকে পরাজিত করে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন ‘ঢাকার ছেলে’ মোহাম্মদ হানিফ।
১৯৯১ সালের ১৯ মে ‘কিশোরগঞ্জের ছেলে’ মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ ওরফে মির্জা আব্বাসকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে বসান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার মেয়র পদে ছিলেন ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোটভুক্ত বিএনপির এই নেতা।
সেবার ঢাকার মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুরো দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর, বিস্ফোরণোম্মুখ। তখনকার সময়ে ঢাকার সবচেয়ে প্রশস্ত সড়কের তকমা পাওয়া মানিক মিয়া এভিনিউতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর হাই-ভোল্টেজ সভা-সমাবেশ তথা মহাসমাবেশ অনুষ্ঠানের একটা ধারাবাহিকতা শুরু হয়। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে দিয়ে সংসদ ভবনের সামনের এই বিশাল ও প্রশস্ত সড়কের জনসভাগুলো থাকতো দেশবাসীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।
এমনি পটভূমিতে মানিক মিয়া এভিনিউতে শীর্ষ দুই মেয়র প্রার্থীর দুটি বিশাল জনসভা অবধারিত ছিল সেবার। মির্জা আব্বাসের সমাবেশটি প্রথমে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রথামাফিক প্রতিদ্বন্দ্বী হানিফকে আক্রমণ করে নানান অভিযোগ উত্থাপন করেন মির্জা আব্বাস। ক্ষমতাসীন দলের মনোনিত মেয়রের বদলে ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হওয়ার চ্যালেঞ্জটা অনেক প্রকট ছিল তখন তার জন্য। তাই তিনি খুব ধারালো আক্রমণ করেন হানিফকে। সেই মঞ্চ থেকে দেওয়া বক্তব্যে একপর্যায়ে বলা হয়, নির্বাচনে পরাজয়ের পর হানিফকে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঢাকা থেকে বের করে দেওয়া হবে।
প্রায় চার বছর ঢাকার নগরপাল (মেয়র) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ভালমন্দ ছাপিয়ে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ তখন বাতাসে ঘুরে বেড়াতো। এর অন্যতম ছিল ‘মি. ২০%’। অর্থাৎ সিটি কর্পোরেশনের যেকোনো কাজ বা টেন্ডারেই তার জন্য ২০% বরাদ্দ রাখতে হতো ঠিকাদারদের। এছাড়া সেই পার্সেন্টেজের ওপর ভিত্তি করেই নাকি পরবর্তীতে ব্যাংক মালিকও বনে যান। তবে এ-ও ঠিক যে, ক্ষমতায় থাকলে সত্য বা মিথ্যা যাই হোক, এ ধরনের অভিযোগ উঠেই থাকে। আর একবার বিশাল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গেলে তখন ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার বাছবিচার না করেও আর্থিক দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি, সন্ত্রাস-খুনের অভিযোগ উঠতেই থাকে।
খ্যাতির বিড়ম্বনার মতো একে সম্পদের বিড়ম্বনা বলা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, যাদের সম্পদ সৎপথে অর্জিত, যারা আসলেই নিরপরাধ তারা বদনাম-অভিযোগের পাহাড় ঠেলে ঠিকই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে থাকেন।
তো পরদিন নিজের জনসভায় মোহাম্মদ হানিফ অনেকটাই বাষ্পরুদ্ধ আবেগ নিয়ে মঞ্চে উঠেন। হানিফের কণ্ঠ এমনিতেই ছিল ভরাট, গম্ভীর এবং আবেশ মাখানো। সেদিন তিনি মির্জা আব্বাসের বা ক্ষমতাসীন বিএনপির দুর্নীতি-অনাচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য যা দিয়েছিলেন তা বেশ জোড়ালোই ছিল। তবে বক্তব্যের একপর্যায়ে আগেরদিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মঞ্চ থেকে হানিফের উদ্দেশ্যে করা ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়।
বিষয়টির স্মৃতিতর্পণে হানিফের দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে লোনা জল। সেই মঞ্চ থেকে ঢাকাবাসীর কাছে বিচার চাওয়া হয় ঢাকার ছেলে হানিফকে ঢাকা থেকে বের করে দেওয়ার হুমকির। হানিফের সেই চোখের জল বৃথা যায়নি। সেই বিচার ভোটের মাধ্যমেই করেছিল ঢাকাবাসী।
একেবারে সাধারণ পর্যায় থেকে উঠে আসা মির্জা আব্বাস ঢাকার মেয়র হওয়ার পর থেকে বিত্ত-সম্পদে ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকেন বলে অভিযোগ হানিফের জনসভার পর অন্য মাত্রা পায়। মেয়র মির্জা আব্বাসের দুর্নীতি প্রসঙ্গ তখন হঠাৎ করেই বড় হয়ে দেখা দেয়। এর পরিষ্কার ছাপ পড়ে ভোটের দিন।
প্রায় একদিনেরও বেশি দেরিতে প্রকাশিত ফলে দেখা যায় মির্জা আব্বাস হেরেছেন এক লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে। অভিযোগ রয়েছে, ফলাফল বদলে দিতে চেষ্টার চূড়ান্ত করেও ব্যর্থ হয় সরকারি পক্ষ। সব ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকির পরও লাখেরও বেশি ভোটে হেরে যান আব্বাস। টানা ১৯ বছর ধরে যে দলটি ক্ষমতায় নেই, সেই দলের প্রার্থী রাজধানী শহরের মেয়র পদে নির্বাচিত- তাও ক্ষমতাসীন দল ও জোটের সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়ে!
অন্যদিকে দল ক্ষমতায় থাকলেও মির্জা আব্বাস কিছুটা অন্তরালে চলে যান। এর সমান্তরালে হানিফের এই বিজয় যেন আওয়ামী লীগের জন্য ছিল কোরামিনতুল্য। একই বছরে মাস দুয়েকের ব্যবধানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচিত হন চট্টলবীর খ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন।
এরপর দুই বছরের মাথায় জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ। তবে ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি জোট আবার ক্ষমতায় আসে। এই নির্বাচনে মির্জা আব্বাস ঢাকা-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। অর্থাৎ দুর্নীতির অভিযোগ যতই থাকুক, মির্জা আব্বাস এবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সে সূত্রে মন্ত্রীও হন। এতে একটা জিনিস পরিষ্কার, ১৯৯৪ সালে মেয়র নির্বাচনের ব্যর্থতার ক্ষত সারিয়ে তিনি তার জনসমর্থন প্রমাণ করেন (যদিও নির্দিষ্ট সংসদীয় এলাকায়)।
তবে অভিযোগ আবারও উঠতে থাকে। সেসব অভিযোগ মতে, প্রাক্তন এই পূর্তমন্ত্রী দুর্নীতির মাধ্যমে খিলগাঁও মৌজায় রেলওয়ের ৩১ শতাংশ জমি অবৈধভাবে নিজনামে অবমুক্ত ও নামজারী করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে একই মৌজাভুক্ত বিভিন্ন দাগ খতিয়ানে আরও দেড় শ কাঠা জমি কূট-কৌশলে নিজের করে নেন। খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকার পার্কের জায়গা নিয়ে নয়ছয় করারও অভিযোগ রয়েছে তার নামে। অভিযোগ মতে, উল্লেখিত জায়গায় প্লট তৈরি করে নিজ নামে/বেনামে বরাদ্দ নিয়ে ২০০ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ করেন তিনি।
গুলশান বনানী এলাকায় মহামূল্যবান ৬০ কাঠা জমি আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রীর বিরুদ্ধে।
উল্লেখিত অভিযোগের ভিত্তিতে সাবেক পূর্তমন্ত্রী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসবের বাইরেও তার বিরুদ্ধে আরও কিছু দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, জোর-জুলুম রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিচিত প্রসঙ্গ। অনৈতিক আর বেআইনি হওয়া সত্ত্বেও ওপরে ওঠা রাজনীতিকদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ। এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মির্জা আব্বাস ও তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
সম্প্রতি মির্জা আব্বাস আবারো আলোচিত তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা বাতিলের আবেদন আপিল বিভাগ কর্তৃক খারিজ করে দেওয়ার সূত্রে। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে এ আদেশ দেন। এর ফলে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে মামলা চলতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গণমাধ্যমকে জানান, ৫ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ২৩৪ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮১ টাকা তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৬ আগস্ট রমনা থানায় মামলা করে দুদক। ওই মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হলে ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর হাইকোর্ট মামলা বাতিলের আবেদন খারিজ করে দেন। শুনানি শেষে আপিল বিভাগও আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার ৬ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
তবে মির্জা আব্বাসের আইনজীবী সগীর হোসেন লিয়ন জানান, ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আয়কর নিয়ে একটি মামলায় মির্জা আব্বাসের দণ্ড যা আপিলে বাতিল হয় এবং তিনি খালাস পান। কিন্তু একই রকম ফ্যাক্টসে দুদকও একটি মামলা করে। তাই তা বাতিলের আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু বিচারিক আদালত, হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে তা খারিজ হয়েছে।
আমরা আশা করি আইন তার নিজের গতিতে চলমান থাক। মির্জা আব্বাস দুর্নীতি করেছেন কি না তা তিনি নিজে জানেন। অনেক সময়ে অনেক জঘন্য আর বিরাট আকৃতির অপরাধও আইনে প্রমাণ করা যায় না। তাই বলে কি তা অপরাধ নয়? আবার নিরপরাধ লোকজনও প্রতিপক্ষের কূটচালে জড়িয়ে বনে যান অপরাধী। তাই বলে বাস্তবে কি তিনি অপরাধী?
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটির এই সদস্য তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তায় নিজেকে নিষ্কলুষ প্রমাণে সফল হবেন- আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সবাই তেমনটিই চাইবেন।
১৯৯৪ সালের মেয়র নির্বাচনী প্রচারণায় মির্জা আব্বাসের পক্ষে একটি ভুল তথা বেফাঁস কথা পুরো ভোটের আবহকে তুমুলভাবে বদলে দিয়েছিল। যেখানে সামান্য ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার কথা সেখানে বিপুল ভোটে প্রতিপক্ষের কাছে ‘অপমানজনক’ পরাজয়। রাজধানী শহরের সেই বিজয় পরবর্তীতে পুরো দেশের ক্ষমতা বদলের সোপান হয়ে দাঁড়ায় বিরোধী দলের জন্য। আমরা মনে করি, এখান থেকে রাজনৈতিক নেতারা বেফাঁস মন্তব্য বিষয়ে একটি শিক্ষা নিতে পারেন।
তবে বেফাঁস মন্তব্য তো প্রায় ক্ষেত্রেই মুখ ফসকে হয়ে যায়। কিন্তু দুর্নীতি, বিশেষ করে সরকারি পর্যায়ে ব্যাপক বিশাল আকারের দুর্নীতি তো মুখ ফসকে হবার কথা নয়। এর জন্য আঁটঘাট বাঁধতে হয়, জনগণকে প্রতারণার জন্য চোখে পট্টি আর বিবেকে ঠুলি পড়তে হয়, বিবেককে ঘুম পাড়াতে হয়। প্রচুর সময় এবং নেতিবাচক মেধাও ব্যয় হয় এর পেছনে। সেসব যারা করেন, তারা কি বিনা দায়ে পার পেয়ে যাবেন?
রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বেফাঁস মন্তব্যের গোনাগারি যখন এত বিশাল তখন জেনেশুনে যারা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন তাদের প্রায়শ্চিত্ত, জরিমানার বিষয়টি কি তারা অবগত আছেন? এই প্রশ্ন দেশের সব রাজনীতিকের কাছে রইলো।
দিনবদলবিডি/আরএজে