ধর্ষণ রোধ: আইনের সঙ্গে সামাজিক অঙ্গীকারও জরুরি
সম্পাদকীয় বিভাগ || দিনবদলবিডি.কম
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তর্ক-বিতর্ক, এমনকি টকশোতে জল কম ঘোলা হয় না। কিন্তু পরিত্রাণ কোথায় বা কিভাবে- তার দেখা মিলছে না।
ছোট্ট একটি শিশু যে নাকি জীবিকার তাগিদে পথে ফুল বিক্রি করছে, সেও পর্যন্ত একশ্রেণির নরপিশাচদের ঘৃণিত ছোবল থেকে ছাড়া পাচ্ছে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই ধর্ষণগুলোর জন্য ক্রমাগত নারীদেরকেই দোষারোপ করা হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি শুধুই কঠোর শাস্তির আইন?
এইতো গেলো বছরের ঘটনা- টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে বেড়াতে গিয়ে নবম শ্রেণির ৪ ছাত্রীর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় তিনজনেই। অপরজন নির্যাতনের শিকার হয়। ঘটনাটি সেসময় ‘টক অব দ্য টাউন’ ছিল। সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ ও নির্মম হত্যা মামলা এখনো তদন্তাধীন। এ রকম শুধু ঢাকা, টাঙ্গাইল নয়, বাস্তবে সারা দেশেই শিশু থেকে শুরু করে কিশোরী, ছাত্রী, গৃহিণী এবং অশীতিপর বৃদ্ধা পর্যন্ত এ ঘটনার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
এর আগেও সারা দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ জানিয়ে সাধারণ মানুষ, মানবাধিকার সংগঠন, এনজিও এবং পত্রিকা ধর্ষকদের বিচার দাবি করছে। কিন্তু ধর্ষণের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছেই।
করোনাকালে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও জনসমাগমে শিশুদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৬২৬টি শিশুই ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই রিপোর্ট মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর। উল্লেখ্য, এটা শুধু শিশু ধর্ষণের পরিসংখ্যান।
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা, তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করলে কখনো কখনো মনে হয়- দেশে বর্তমানে বুঝি ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ বিরাজ করছে। ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ বলতে এমন এক সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়, যেখানে সমাজের প্রত্যেক নারী, শিশু কিংবা কিশোরী ধর্ষণের মতো পরিস্থিতির শিকার হতে পারে।
ইউএন উইমেনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শোকো ইশিকাওয়া গত বছরের ১১ অক্টোবর প্রকাশিত এক দৈনিকে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, ‘২০১১ সালের এক গবেষণায় আমরা দেখেছি, নারীকে যৌন নির্যাতন করেছেন এমন পুরুষদের প্রায় ৩০ শতাংশ বলেছেন, তারা মনে করেন নারীদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করার অধিকার তাদের আছে। তারা বলেছেন- নারীদের শাস্তি দিয়েছেন এবং শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে নিজের ক্রোধ মিটিয়েছেন, এ অধিকার তাদের আছে।’
‘৭৭ শতাংশ শহুরে পুরুষ এবং ৮১ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের পুরুষ বলেছেন, তারা মনে করেন যে যৌনতা হলো পুরুষের অধিকার। এ মানসিকতা হলো টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বা বিষাক্ত পৌরুষ্যের মানসিকতা। নারীকে ধর্ষণসহ অন্যান্য সহিংসতা এবং অপমান থেকে রক্ষা করতে হলে সমাজকে এ বিষাক্ত পুরুষত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে।’
অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশে ধর্ষণের হার বাড়ার অন্যতম কারণ হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনাগুলোর বিচার না হওয়ার ধারাবাহিকতা অর্থাৎ বিচারহীনতা। দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে তুলনায় বিচারের হার অত্যন্ত কম।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রায় সব দেশেই নানাবিধ আইন রয়েছে। তাতে রয়েছে কঠোর শাস্তিও। যেমন- ভারত, ইরান, চীন, গ্রিস ও রাশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুণ্ড। যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়েসহ উন্নত দেশগুলোতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছর কারাদণ্ড। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থাকলেও কদিন আগে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় সব দেশেই ধর্ষণের কঠোর শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু তবুও এ চরম পৈশাচিক অপরাধ বন্ধ হয়নি। বরং দিন দিন বেড়েছে। উল্লেখ্য, সংশোধিত নয়া আইনে করা মামলায় প্রথম রায়ও হয়েছে, যাতে ৫ জন ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আইনে শাস্তি বাড়ালেই কি এমন অপরাধ কমবে? তার নিশ্চয়তা নেই। ন্যায় বিচার নিয়েও থাকে শঙ্কা। কারণ আইনের প্রয়োগ যদি যথাযথ না হয়, তদন্ত যদি সুষ্ঠু না হয়, মামলার ভিকটিম বা সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে না।
মূলত ধর্ষণ রোধে সামগ্রিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে আমাদের। এ ক্ষেত্রে সামাজিকীকরণের ভূমিকা সংষ্কার করতে হবে। জন্মের পর থেকেই পরিবার, স্কুল কিংবা বৃহৎ সামাজিক কাঠামোতে নারীর এবং পুরুষের আলাদা সামাজিকীকরণ দূর করতে হবে। কারণ সামাজিকীকরণের ভিন্নতার কারণে নারী ও পুরুষের মর্যাদা বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্নভাবে গড়ে ওঠে। নারীর অধঃস্তনতামূলক মর্যাদার প্রথা ভেঙে সমমর্যাদার ও সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে রাজনৈতিকভাবে পরিচিত সন্ত্রাসী ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিসহ সব অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। নারী-পুরুষের জন্য স্বাভাবিক মুক্ত সমাজ নির্মাণ করতে সরকারি-বেসরকারিভাবে রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ধর্ষণসহ সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে জনগণের সামাজিক অঙ্গীকার ও অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
দিনবদলবিডি/এস