ভাষাদূষণ রোধে সচেতনতা জরুরি
সম্পাদকীয় বিভাগ || দিনবদলবিডি.কম
পৃথিবীর অন্য যেকোনো মাতৃভাষা থেকে আমাদের বাংলা ভাষা অনেক বেশি গৌরবের। কারণ বাংলা ভাষা একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। আমাদের দেশই পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। তবে সময়ের পরিক্রমায় সেই ভাষারই স্বকীয়তা নষ্ট হতে চলেছে; যা কাম্য নয়।
বর্তমানে বাড়াবাড়ি রকমের বিকৃত ধ্বনি ও বিদেশি শব্দের অহেতুক ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এ প্রজন্মের সন্তানরা এটির একটি নামও দিয়েছে। বাংলা কিংবা ইংলিশ কোনোটিই নয়। এটা হলো বাংলিশ।
‘বাংলা’ শব্দের ‘বাং’ আর ‘ইংলিশ’ এর ‘লিশ’ যুক্ত করে এরকম নামকরণ করা হয়েছে।
এটি যে ভাষাদূষণ, ভাষা বিকৃতি এবং ভাষার জগাখিচুড়ি প্রয়োগ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এফএম রেডিওগুলোর বিকৃত ও অশুদ্ধ উচ্চারণের কারণে কিশোর-তরুণরা ভাষার বিষয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এটি শুধু বাংলা নয়, অন্য যে ভাষার শব্দ যোগ করে অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরি করা হচ্ছে সে ভাষারও অমর্যাদা করা হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।
আবার ভাবনার বিষয় হচ্ছে, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এসব পছন্দও করছেও। কারণ, তাদের বিরাট অংশ যুগের স্রোতে ভেসে আসা যে কোনো ফ্যাশনকে বিচার-বিবেচনা ছাড়াই, দ্রুত রপ্ত করে সেটার প্রয়োগ করাকে আধুনিকতা ভাবে।
শহুরে তরুণ প্রজন্মের মুখের এমন ভাষায় বিস্মিত না হয়ে উপায় কী! তারা যেন বাংলা ‘র’ ধ্বনিটি ভুলেই গেছে। তার জায়গায় প্রিয় হয়ে উঠেছে ‘ড়’। আর ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলার প্রবণতাও বাড়ছে।
বিশ্ববাজারের দ্রুত সম্প্রসারণ অথবা মুক্তবাজার অর্থনীতির টাইফুন ঝড়ে আজ দেশীয় ঝালমুড়ি, চানাচুরের মোড়কগুলোও ভোল পাল্টেছে। দেশি ফলের গন্ধ ও স্বাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ম্যাঙ্গো ফ্লেভার’। ইংরেজি নাম ছাড়া যেন মুখে স্বাদ লাগে না। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অহেতুক বিদেশি ভাষাপ্রীতির কারণে আজ বাংলা নামের খাদ্য মানেই অখাদ্য যেন।
সরকারি অফিস-আদালত, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল-রেস্তোরাঁ- সবখানেই বাংলা হরফে ইংরেজি অথবা ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা। ক্রমাগত বাড়ছে এই প্রবণতা। টিভি নাটক, চলচ্চিত্রের নামকরণেও আজ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অহেতুক ইংরেজির আধিপত্য। এতে আমাদের ভাষার মর্যাদা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
সারা বিশ্বে বর্তমানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ কোটি; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা মিলিয়ে ১২ কোটি এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির সংখ্যা কম-বেশি এক থেকে দেড় কোটি। এই বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারীদের নিয়ে একটি ভাষার টিকে থাকা অত্যন্ত সংগত ও ইতিবাচক। যেখানে শত শত ভাষা নিজস্ব ভাষা ব্যবহারকারী হারিয়ে লুপ্ত হওয়ার মুখোমুখি, সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয়জয়কার সর্বত্র। এত অর্জনের পরও আমাদের ভালোবাসার বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে দিন দিন। এর জন্য মূলত দায়ী আমরাই।
জাতিসংঘের তথ্য মতে, ‘প্রতি দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে।’ বাংলা ভাষা আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব। তাই এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে এবং বাংলা থেকে ভাষাদূষণ, ভাষা বিকৃতি এবং ভাষার জগাখিচুড়ি প্রয়োগ রুখতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাংলাই পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যার প্রতি ভালোবাসা ও মর্যাদাবোধ থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম। আমরা আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করেছি এটা অনন্য গর্বের বিষয়।
তবে কষ্টের কথা হলো, আমাদের এখানে আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার রয়েছে, অথচ তারা কেউই আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে জনসাধারণের কাছে জোরদার কোনো ভূমিকা রাখছে না।
স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে ভাষার বিকৃতি রোধ এবং সঠিক বানান ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার এবং বাংলা একাডেমিকে প্রচলিত বানান এবং উচ্চারণরীতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।
আজকের প্রজন্ম যেহেতু গণমাধ্যম দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং হচ্ছে, তাই আমাদের ভাষার স্বকীয়তা রক্ষায় ইতিবাচক কৌশলে সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা উচিত। গণমাধ্যমের সাহায্যে ভাষা বিকৃতির সব অপচেষ্টা বন্ধে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। একইসঙ্গে ভাষার এই অবক্ষয় মূলত সামাজিক অবক্ষয়েরই আরেকটি রূপ। শুধু আইন করে এই অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ভাষাকে বিকৃত করার মাধ্যমে আমরা যে আমাদের নিজেদেরই হেয় করে তুলছি তা বোঝাতে হবে।
দিনবদলবিডি/এস