জুমার দ্বিতীয় আজান চালু হলো যেভাবে

দিন বদল বাংলাদেশ ডেস্ক || দিন বদল বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ সন্ধ্যা ০৬:৩৭, বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

জুমার দিন সপ্তাহের সেরা দিন। দিনটি মহান আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন, যা অন্যকোনো জাতিকে দেওয়া হয়নি। এই দিনের নামে পবিত্র কুরআনে একটি স্বতন্ত্র সুরা আছে। সেখানে জুমার দিনের প্রধান আমলের কথা বলা হয়েছে, অসংখ্য হাদিসে জুমার বিভিন্ন আমল ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে‌।

আর আজান শব্দের অর্থ হচ্ছে ডাকা, আহবান করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় জামাআতের সঙ্গে নামাজ আদায় করার লক্ষ্যে মানুষকে মসজিদে একত্রিত করার জন্য আরবি নির্দিষ্ট শব্দ ও বাক্যের মাধ্যমে উচ্চকণ্ঠে ডাক দেওয়া বা ঘোষণা করাকেই আজান বলা হয়। ৫ ওয়াক্ত নামাজেন সময় আজান একবার দেওয়া হলেও জুমার আজান দুইবার দেওয়া হয়।

প্রথম যুগে জুমার আজান

আল্লাহর রাসুল (সা.) এবং হজরত আবু বকর ও হজরত উমর (রা.)-এর জামানায় জুমার দিন মাত্র একটি আজান ও ইকামত প্রচলিত ছিল। হজরত সায়িব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মদিনার অধিবাসীদের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পেল, তখন জুমার দিন দ্বিতীয় আজান যিনি বৃদ্ধি করলেন, তিনি হলেন হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.)। নবী কারিম (সা.)-এর সময় জুমার জন্য একজন ব্যতীত মোয়াজ্জিন ছিল না এবং জুমার দিন আজান দেওয়া হতো, যখন ইমাম বসতেন অর্থাৎ মিম্বরের ওপর খুতবার পূর্বে। –সহিহ বোখারি : ৮৬৭

দ্বিতীয় আজানের প্রচলন

হজরত উসমান (রা.)-এর খেলাফতকালে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। বহু এলাকা মুসলমানদের খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন তিনি সবাইকে জুমার নামাজের সম্পর্কে জানানোর জন্য সাহাবায়ে কেরামের সম্মতিতে দ্বিতীয় আজানের প্রচলন করেন।

হজরত সায়িব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারিম (সা.) হজরত আবু বকর (রা.) এবং হজরত উমর (রা.)-এর সময় জুমার দিন ইমাম যখন মিম্বরের ওপর বসতেন তখন প্রথম আজান দেওয়া হতো। পরে যখন হজরত উসমান (রা.) খলিফা হলেন এবং লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পেল তখন তিনি জাওরা থেকে দ্বিতীয় আজান বৃদ্ধি করেন। ইমাম বোখারি (রহ.) বলেন, জাওরা হলো- মদিনার অদূরে বাজারের একটি স্থান। –সহিহ বোখারি : ৮৬৭

দ্বিতীয় আজান সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত

দ্বিতীয় আজানের প্রবক্তা হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) হওয়ার কারণে তাকে বেদআত বলা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নত, উম্মতের জন্য অনুসরণীয়।

হজরত ইরবাজ ইবনে সারিয়া (রা.) বলেন, একদিন ফজরের নামাজের পর হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে এমন এক উচ্চাঙ্গের নসিহত করলেন যে, তাতে আমাদের চক্ষু থেকে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে লাগলো এবং অন্তর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তখন এক ব্যক্তি বললেন, এতো বিদায়ী ব্যক্তির মতো নসিহত- ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি আমাদের ওপর কি অসিয়ত করে যাচ্ছেন? তিনি বললেন, তোমাদের আমি আল্লাহকে ভয় করার অসিয়ত করছি, যদি এ হাবশি গোলামও আমির নিযুক্ত হয়, তবুও তার প্রতি অনুগত থাকবে। তার নির্দেশ শুনবে। তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা বহু বিরোধ প্রত্যক্ষ করবে। তোমরা সাবধান থাকবে নতুন নতুন বিষয়ে লিপ্ত হওয়া থেকে। কারণ তা হলো- গোমরাহি। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ওই যুগ পাবে তার কর্তব্য হলো- আমার সুন্নত এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নতের ওপর অবিচল থাকা। এগুলো তোমরা চোয়ালের দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকবে। –সুনানে আবু দাউদ : ৪৫৫২

জুমার আজানের পর যেসব কাজ করা যাবে না

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা জুমার আজানের পর যে বেচাকেনা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন, তা মূলত জুমার দ্বিতীয় আজান। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রুত ছুটে যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা উপলব্ধি করো।’ (সুরা জুমুআ: ৯)

আলিমগণ বলেন, জুমার দ্বিতীয় আজানের পর সব ধরনের পার্থিব কাজকর্ম করা হারাম। এতে কারও দ্বিমত নেই।

আর প্রথম আজান সম্পর্কে ফকিহগণ বলেছেন, প্রথম আজানের পরও জুমার প্রস্তুতিমূলক কাজ- যেমন গোসল, অজু, টয়লেট, কাপড় পরিধান ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোনো কাজ করাও নাজায়েজ।

জুমার দিন জুমার খুতবা শুরু হওয়ার পর থেকে কোনও ধরনের কথা বলা নিষেধ এবং চুপ করে মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা ওয়াজিব। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন- জুমার দিন খুতবার সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে ‘চুপ করো’ বলো সেটাও অনর্থক। (বুখারি, হাদিস: ৮৯২; মুসলিম, হাদিস: ২০০৫)

হাদিস দ্বারা সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়, খুতবার সময় নিশ্চুপ হয়ে খুতবা শোনা ওয়াজিব ও কথাবার্তা বলা হারাম। অনুরূপ খুতবার সময় সুন্নত-নফল নামাজ পড়াও বৈধ নয়। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না।’ (মেশকাত, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪৩২)

জুমার দ্বিতীয় আজানের জবাবের বিধান

আজান শোনা ও আজানের উত্তর দেয়া সুন্নত। শ্রবণকারীরা আজানের উত্তর মৌখিকভাবে দিতে হয়। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) হাদিসে বলেন, ‘যখন তোমরা আজান শুনবে, তখন জবাবে মুয়াজ্জিনের মতো তোমরাও তা বলবে।’ (বুখারি, হাদিস: ৬১১)

অনেকে জানতে চান, জুমার দ্বিতীয় আজান অর্থাৎ খুতবার আজানের উত্তর দেয়া ও দোয়া পড়া জায়েজ আছে কিনা? এ বিষয়ে আলেমদের মতামত হলো- ফেকাহবিদদের নির্ভরযোগ্য মতানুযায়ী জুমার দ্বিতীয় আজানের সময় যখন খতিব মিম্বরে উপবিষ্ট থাকেন, তখন এ আজানের  উত্তর মৌখিক না দেওয়াটা উত্তম। তা সত্ত্বেও কেউ দিতে চাইলে মনে মনে জবাব দিতে পারে। (আদ্দুররুল মুখতার: ১/২৯৯, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া: ২/৫৮)।

সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব (রাহ.) বলেন, ইমাম খুতবার জন্য বের হলে নামাজ পড়া যাবে না আর ইমাম খুতবা শুরু করলে কথা বলা যাবে না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৫৩৪২)

খুতবার সময় যেহেতু চুপ থাকা ও মনোযোগ সহকারে খুতবা শোনা ওয়াজিব তাই আজানের পরপরই ইমাম খুতবা শুরু করে দিলে আজানের দুআ পড়া যাবে না। কিন্তু যদি ইমাম খুতবার জন্য দাঁড়াতে বিলম্ব করেন তবে এ সময় আজানের দোয়াও পড়া যাবে।

(ফাতহুল বারী ২/৪৬০; ইলাউস সুনান ২/৮০; আসসিআয়াহ ২/৫৩; হাশিয়াতুত তহতাবী আলালমারাকী ২৮২; আততাজরীদ ২/৪৭৭; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ৩/২০০ওই সময় হাত তুলে মোনাজাতের রীতি ভিত্তিহীন। এটা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

সপ্তাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত জুমার নামাজ। এটি মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করতে হয়। সৃষ্টিজগতের শুরু থেকে দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনের ফজিলত সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থগুলোতে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

বিখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। রাসুল সা. একটি হাদিসে বলেছেন, মুমিনের জন্য জুমার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর ১০৯৮)।

ইসলামের প্রথম যুগে জুমার আজান একটি ছিল। তখন শুধু খুতবার আগেই আজান দেওয়া হতো। পরে মানুষের অবহেলা বেড়ে গেলে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) প্রথম আজানটি চালু করেন। এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম ঐকমত্য পোষণ করেন। ফলে ইজমার মাধ্যমে প্রথম আজানও জুমার অংশে পরিণত হয়।

দিনবদলবিডি/Anamul

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়