গ্যাস সংকটে লোডশেডিং, নাভিশ্বাস দেশজুড়ে

দিন বদল বাংলাদেশ ডেস্ক || দিন বদল বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ সকাল ১১:৫৩, মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০২২, ২১ আষাঢ় ১৪২৯
ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

দেশজুড়ে গত কয়েকদিন ধরে লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। আর এই পরিস্থিতি থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যাবে না বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট চরম আকার ধারণ করায় রাজধানীতে এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হচ্ছে। দুপুরের পর এই পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে অসহ্য গরমে ঢাকার অনেক এলাকার মানুষ বাসাবাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ঢাকার বাইরে গ্রামগুলোতে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার চলছে। কোনো কোনো গ্রামের মানুষ সারাদিনেও এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ পায় না।

সূত্র মতে, গত এক বছর ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম ওঠানামার মধ্যে ছিল। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জ্বালানির দাম আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বাড়ছে এলএনজির দামও। পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েক মাস আগে এলএনজি কেনার জন্য কাতারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিল বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। কিন্তু চুক্তির বাইরে এলএনজি দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয় কাতার সরকার। এরপর দেশে মজুত থাকা এলএনজি কমতে শুরু করে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, এলএনজি আমদানি কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন গত কয়েকদিনে এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, জ্বালানি তেলের দামও বাড়তি। এতে দিনে ১০৮ কোটি টাকা লোকসান গুনছে বিপিসি। তাই তেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।

এদিকে, লোডশেডিংয়ের প্রভাব গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পড়েছে বলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসছে। চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। চুয়াডাঙ্গা শহরের কোর্ট মসজিদ এলাকার পুরোনো চায়ের দোকানদার আনোয়ার হোসেন রফিক। তিনি বলেন, ‘বার বার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় গরমে দোকানে বসে কেউ চা খেতে পারছে না। সে কারণে বিক্রি কমে গেছে।’

দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ওষুধ বিক্রেতা আতিয়ার রহমান জানান, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ আসে। বেশিরভাগ সময়ই লোডশেডিং। এতে গরমে সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হচ্ছে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের। বিদ্যুৎ লোডশেড প্রসঙ্গে চুয়াডাঙ্গা ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মঈনুদ্দিন বলেন, ‘গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সে কারণেই লোডশেডিং। ইদের আগ দিয়ে লোডশেডিং কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে।’

লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে মানিকগঞ্জ থেকেও। জানা গেছে, ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মানিকগঞ্জের জনজীবন। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হাওয়াই ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সাধারন মানুষ নাভিশ্বাস উঠেছে। মানিকগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চাহিদার তুলনায় মানিকগঞ্জে কম বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়ায় এই লোডশেডিং হচ্ছে।

মানিকগঞ্জে একাধিক বড় শিল্প কারখানার কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে এমনিতেই বিপর্যস্থ। এরপর ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উৎপাদন। গত কয়েকদিন ধরে লোডশেডিংয়ে মাত্রাটা অনেক বেশি। এভাবে প্রতিনিয়ত লোডশেডিং চলতে থাকলে উৎপাদনে ধস নামবে বলে ওই কর্মকর্তারা জানান।

এদিকে, লোডশেডিংয়ে নাজেহাল রংপুরবাসী। বিভাগের আট জেলায় লোডশেডিংয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রচণ্ড গরম। এতে জনজীবন অচল হয়ে পড়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে এই বিভাগের শত শত কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া ইদকে সামনে রেখে বেচাকেনার ভরা মৌসুমেও শপিং মল ও বিভিন্ন দোকানে ক্রেতার দেখা নেই।

রংপুর বিদ্যুৎ বিভাগের নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি নেসকোর প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন জানান, রংপুর বিভাগে নেসকো আর পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। দিনের বেলায় রংপুর বিভাগে বিদ্যুতের চাহিদা ৬০০ মেগাওয়াট। সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৪০০ মেগাওয়াট। সন্ধ্যার পর থেকে চাহিদা ৭০০ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০০ মেগাওয়াট। এ অবস্থা সাময়িক দাবি করে নেসকোর ওই প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘আশা করি দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

বরিশাল প্রতিনিধি জানান, হঠাৎ করেই বেড়েছে লোডশেডিং। জানা গেছে, দিনে একাধিকবার, এমনকি রাতেও বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। প্রচণ্ড গরমে কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় নগরবাসীর ভোগান্তি বেড়েছে। নগরীর নবগ্রাম রোড, খান সড়ক, রূপাতলী, আমানতগঞ্জ, নতুন বাজার, কাউনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

একইরকম অবস্থার কথা জানিয়েছেন আমাদের সিলেট প্রতিনিধিও। তিনি জানান, সিলেটেও বাড়ছে লোডশেডিং। তীব্র গরমে অতিষ্ট জনজীবন হাঁপিয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকার কারণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সিলেট বিভাগে শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি লোডশেডিং করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিলেটে সোমবার সকাল থেকে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৪৫০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সরবরাহ পেয়েছেন ৩৫০ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল ১০০ মেগাওয়াট।

সিলেট বিভাগ বিদ্যুৎ উন্নয়নের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল কাদির সারাবাংলাকে জানান, সিলেট জেলাতে সোমবার ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। এ কারণে চাহিদা বিবেচনা করে বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং করতে হয়েছে। সরবরাহ প্রাপ্তি সাপেক্ষে লোডশেডিং কমিয়ে আনা হবে বলে জানান তিনি।

যশোর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, লোডশেডিংয়ের কারণে তিন দিন ধরে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা। শহরে কিছুটা বিদ্যুৎ পাওয়া গেলেও গ্রামের অবস্থা খারাপ। কতবার যে বিদ্যুৎ যাচ্ছে-আসছে তা বলতে পারছেন না অনেকেই। এতে মানুষের জীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎ বিভাগও লোডশেডিংয়ের কথা স্বীকার করে জানিয়েছে চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎও জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে, বিদ্যুৎ না থাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ইখতিয়ার উদ্দিন এই মারাত্মক বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে জানান, তাদের এক লাখ ৬ হাজার (প্রায়) গ্রাহক রয়েছে। এর শহরাংশের জন্যে দৈনিক ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। সেখানে জাতীয় গ্রিড থেকে ২৭ থেকে ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। এটা দিয়ে দিনের অর্ধেক চাহিদাও ঠিক মতো মেটানো যাচ্ছে না। তিনি আরও জানান, জাতীয় গ্রিডে সব যন্ত্রপাতি আছে। তবে উৎপাদনের কাঁচামাল গ্যাস ঘাটতি আছে বলে তিনি শুনেছেন।

এদিকে লোডশেডিংয়ের খবর আসছে পার্বত্য অঞ্চল খাগড়াছড়ি থেকেও। সেখানে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন অতীষ্ঠের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং আর প্রচণ্ড গরমে নাকাল হয়ে পড়েছে বগুড়াবাসী। শহর ও গ্রামে কোথাও শান্তি নেই। সবখানেই চলছে সমানতালে লোডশেডিং আর গরম। দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় পরিবারের ছোট শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সরকারি ঘোষনা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা। বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে সাময়িক পরীক্ষা। লোডশেডিংয়ের ফলে শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছে। এছাড়া বগুড়া জেলায় চার হাজারের অধিক শিল্পকারখানা ও বড় বড় অটোরাইচ মিল রয়েছে। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে এসব শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, বর্তমানে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। সাধারণত গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করা হয়। গত দুই দিন ধরে দিনে ২৭৫ থেকে ২৮০ ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এলএনজি কেনা না হলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে, বিশ্ববাজারে এলএনজির প্রতি ইউনিটের দাম ৩৮ ডলার ছাড়িয়েছে। সবশেষ সরবরাহ করা হয়েছিল ২৫ ডলারে। এলএনজি সরবরাহকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গত মাসে স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে তিনটি কার্গো এসেছে। দিনে ৭৫ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়েছে। এ মাসে গত কয়েক দিনে ৫০ কোটি ঘনফুটের বেশি সরবরাহ করা যাচ্ছে না।’

এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম আকাশচুম্বী। দাম কিছুটা কমলে খোলা বাজার থেকে আমদানি করা হবে। এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’

গ্যাস সংকটের কারণে চাহিদার চেয়ে ৩০০ মেগাওয়াট কম সরবরাহ করতে পারছে ডিপিডিসি। সূত্র বলছে, সংস্থাটির দৈনিক চাহিদা ১৬০০ মেগাওয়াট, কিন্তু সরবরাহ করতে পারছে ১৩০০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে বিতরণ সংস্থা ডেসকোর চাহিদা ১০০০ মেগাওয়াট, সরবরাহ করতে পারছে ৮৫০ মেগাওয়াট। দেশের অর্ধেকেরও বেশি ৫৫% বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা আরইবি। গত দু’দিনে সংস্থাটির সরবরাহ কমেছে ৮৫১ মেগাওয়াট। যে কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে বর্তমানে ১৪ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে কমপক্ষে ৭০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত কম উৎপাদন হচ্ছে।

এদিকে, এই পরিস্থিতিতে দেশবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। নিজের ভেরিফাইড ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গায়-ই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে। যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্যান্য সব দেশের মতো আমাদেরকেও সমস্যায় ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি।’

দিনবদলবিডি/আরএজে

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়