যেসব কারণে হারলেন শিল্পী মমতাজ

নিউজ ডেস্ক || দিন বদল বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ রাত ১০:৪৭, সোমবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৪, ২৪ পৌষ ১৪৩০
ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

দলের মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে চমক দেখিয়ে প্রথমবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। অপরদিকে সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ বেগম ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জ-২ আসনে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান জাহিদ আহমেদের কাছে ৬ হাজার ১৭১ ভোটে পরাজিত হয়েছেন তিনবারের সংসদ সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। এ আসনে প্রায় দেড় যুগ ধরে সংসদ সদস্যের নামের তাজটি ছিল মমতাজের মাথায়। তবে এবারের নির্বাচনে সেই তাজটি হারিয়ে ফেলেন তিনি।

নির্বাচনের ফলাফলে টানা তিনবারের এই সংসদ সদস্যের এমন পরাজয়ের নেপথ্যে বেশ কিছু বিষয় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তাদের মতে, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহীউদ্দিনসহ দলীয় নেতাকর্মী এবং নির্বাচনী আসনের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধির বিপক্ষ অবস্থান, দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকা ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে যোগাযাগের ঘাটতি। এ ছাড়া মমতাজের আত্মীয়-স্বজন ও নিজের অনুসারী নেতাদের নিয়ে দলের কমিটি গঠনসহ আরও কয়েকটি কারণে নৌকা প্রতীক পেয়েও মমতাজ জয়ী হতে ব্যর্থ হন।

২০২৩ সালের ১৪ জনু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেন। এই কমিটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদ পান। দলের পদ পাওয়া আগে থেকেই তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন।

জাহিদ আহমেদ তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী। রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও অল্প সময়ের মধ্যে নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের মাঝে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। দলের মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে চমক দেখিয়ে প্রথমবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। অপরদিকে সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ বেগম ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জ-২ আসনে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মমতাজ বেগম আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিংগাইর, হরিরামপুর ও সদরের তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-২ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৯ জন। গতকাল রোববার (৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-২ আসনে ১০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মমতাজ বেগম এবং দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এ নির্বাচনে নৌকার প্রতীকের প্রার্থী মমতাজ বেগম ৮২ হাজার ১৩৮ ভোট পেয়েছেন। আর দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহমেদ পেয়েছেন ৮৮ হাজার ৩০৯ ভোট। নির্বাচনে ৬ হাজার ১৭১ ভোট বেশি পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

মমতাজ বেগমের পরাজয়ের নেপথ্যে

মানিকগঞ্জ-২ আসনের নির্বাচনী এলাকার হরিরামপুর উপজেলার পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান এবং সিংগাইর উপজেলা পরিষদের (সদ্য পদত্যাগ করা) চেয়ারম্যান মুশফিকুর রহমান খানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ মমতাজ বেগমের। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মুশফিকুর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মমতাজ তার ঘনিষ্ট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুর রহমানকে দাঁড় করান। নির্বাচনে মুশফিকুর রহমান উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে তাদের মধ্যে বিরোধ আরও বেড়ে যায়। মুশফিকুর রহমান এই নির্বাচনেও দলের স্বতন্ত প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান।

স্কুলের ব্যবস্থপনা কমিটির নির্বাচন

হরিরামপুর উপজেলার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনে সভাপতি পদে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন মমতাজ। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে স্থগিত হয় নির্বাচন। এরপর থেকেই উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমানের সঙ্গে মমতাজের মধ্যকার সম্পর্কের ফাঁটল ধরে। যার কারণে সাইদুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে জোড়ালোভাবে তার অনুসারীদের নিয়ে প্রচার-প্রচারণায় নামেন। এতে ভোটের মাঠে মমতাজের কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হয়।

জেলা পরিষদ নির্বাচন

গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে মমতাজ বেগমের নির্বাচনী এলাকায় অনেক কম ভোট পান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহীউদ্দিন। এরপরও চেয়ারম্যান পদে তিনি নির্বাচিত হন। এ ঘটনার পর থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে মমতাজের সম্পর্কের অবনতি হয় এবং দূরত্ব বাড়তে থাকে। সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় মমতাজ দলের সভাপতি মহীউদ্দীনকে নিয়ে বিভিন্ন কটুক্তিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় মহীউদ্দীন মমতাজের প্রতি আরও ক্ষুব্ধ হন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন।

অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান বিপক্ষে অবস্থান

মানিকগঞ্জ-২ আসনের ২৭টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধির সঙ্গে যোগযোগের ঘাটতি ছিল। এ কারণে অধিকাংশ চেয়ারম্যান নির্বাচনে মমতাজের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহমেদের পক্ষে সরাসারি নির্বাচনী মাঠে কাজ করেছেন। মমতাজের পরাজয়ের এটিও অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সাধারণ ভোটার ও দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি

সর্বশেষ ২০২২ সালে সম্মেলন হলেও সভাপতির পদটি তিনি ভাগিয়ে নেন। শুধু তাই নয়, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ খানকে সরিয়ে তার আত্মীয় শহিদুর রহমানকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ দেওয়া হয়। মমতাজ বেগম আট বছরেরও বেশি সময় ধরে সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে রয়েছেন।

এ ছাড়া তার সৎ ছেলে আবু নঈম মো. বাশারকে সিংগাইর উপজেলা পৌর মেয়র নির্বাচিত করা, তার একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে পদ না পাওয়ায় অনেক যোগ্য নেতা ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ কারণে দলের অনেক নেতাকর্মী তার পক্ষ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন।

জমিজমা ও সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে নিয়ে মমতাজরে সঙ্গে তার সৎ বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরোধ রয়েছে। নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে তার তিন সৎ বোন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে তাদের পক্ষে কাজ করেন। যা নির্বাচনী এলাকার সাধারণ জনমনে আলোচনা-সমালোচনায় ঝড় তুলে। এ ছাড়া নির্বাচনে মমতাজের অনুসারী নেতাদের কেউ কেউ ভোটারদের হুমকি-ধমকি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের প্রচারণায় বাধাসহ প্রাণ নাশের হুমকি দেন। এসব ঘটনা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব পড়েছে ভোটের দিন।

দীর্ঘদিন ধরে স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহমেদ নির্বাচনী এলাকার দরিদ্র ও অস্বচ্ছল ভোটারদের আর্থিক সহযোগিতা, কর্মসংস্থানের জন্য ইজিবাইক, গবাদি পশু, শীতবস্ত্র বিতরণ এবং বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয়ের চেষ্টা করেন। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে টাকা ও সাবানসহ বিভিন্ন মালামাল দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করেন।

দলের প্রার্থীর পরাজয়ের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহীউদ্দীন বলেন, প্রধানমন্ত্রী আস্থা রেখে মমতাজ বেগমকে নৌকা প্রতীক দিয়েছিলেন, তবে তিনি নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ভোটাদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। এ ছাড়া দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে মমতাজ বেগমের হেরে যাওয়ার মূল কারণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পরাজয়ের বিষয়ে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহমেদ বলেন, এই আসনে মমতাজ বেগম সংসদ সদস্য হিসেবে ১৫ বছর ছিলেন। এ ছাড়া তিনি একজন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থাকবেই, সাধারণ জনগণ হয়ত এবার নতুন কিছু ভেবে আমাকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছেন। তবে পরাজিত হলেও আগামী দিনগুলোতে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে মমতাজ বেগমের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করব।

নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়ে জানতে আজ সোমবার (৮ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি। তবে যোগাযোগ করা হলে সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুর রহমান জানান, নির্বাচনে আগে ব্যাপকভাবে কালো টাকার ব্যবহার ব্যবহার নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকার কিছু কিছু ভোটকেন্দ্রে কারচুপিও এই ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে।

দিনবদলবিডি/Mamun

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়