স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪৪

ইসলামে নতুন বছর পালনের কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ আল্লাহর দেওয়া প্রতিটি দিনই…

স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪৪। মুসলমানের জীবনে হিজরি সন বা চন্দ্রবর্ষের প্রভাব ব্যাপক। হিজরি সনের প্রথম মাস হলো মহররম।

মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। বাংলাদেশের আকাশে শনিবার (৩০ জুলাই) ১৪৪৪ হিজরি সনের মহরম মাসের চাঁদ দেখা গেছে। হিজরি সন গননা করা হয় সন্ধার পর থেকে সুতরাং আজ আজ রবিবার (৩১ জুলাই) পহেলা মুহররম। 

পবিত্র কোরআনুল কারিম ও হাদিস শরিফে মহররম মাসকে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ বলা হয়েছে। কোরআনের ভাষায় এটি সম্মানিত চার মাসের ‘আরবাআতুন হুরুম’ অন্যতম।

এ মাসে রোজা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর কাছে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২/৩৬৮; জামে তিরমিজি, হাদিস : ১/১৫৭)।

আশুরার রোজা সম্পর্কে এক হাদিসে আছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে- আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১/২৪১)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোজা রাখব।’ (সহিহ মুসলিম : ১/৩৫৯)।

ইসলামে নতুন বছর পালনের কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ আল্লাহর দেওয়া প্রতিটি দিনই সুন্দর এবং মঙ্গলময়। 

হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্ময়রণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তথা দ্বীনের স্বার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামদের হিজরতের বছর থেকেই হিজরি সনের সূচনা।

খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনে প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মূসা আশআরি (রা.) ইরাক ও কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হজরত আবু মূসা আশআরি (রা.) খলিফা ওমর (রা.) এর খেদমতে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সংবলিত যেসব চিঠি আমাদের কাছে পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোন চিঠি কোন দিনের তা নিরূপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদের নির্দেশ কার্যকর করতে সমস্যা হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রত বোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে।

হজরত আবু মূসা আশআরির চিঠি পেয়ে হজরত ওমর (রা.) এ মর্মে পরামর্শসভার আহ্বান করেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামি তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। ওই পরামর্শসভায় হজরত ওসমান (রা.) হজরত আলী (রা.)-সহ বিশিষ্ট অনেক সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সবার পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে ওই সভায় ওমর (রা.) সিদ্ধান্ত দেন ইসলামি সন প্রবর্তনের।

তবে কোন মাস থেকে বর্ষের সূচনা করা হবে তা নিয়ে পরস্পরের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ এ মত পোষণ করেন- রাসূল (সা.) এর জন্মের মাস রবিউল আওয়াল থেকে বর্ষ শুরু করার। আবার কেউ কেউ মত পোষণ করেন রাসূলের সা.) ওফাতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। অন্যান্যের মতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর হিজরতের মাস থেকে বর্ষ করা হোক। এভবে বিভিন্ন মতামত আলোচিত হওয়ার পর হজরত ওমর (রা.) বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা যাবে না। কারণ খ্রিষ্টান সম্প্রদায় হজরত ঈসা (আ.) এর জন্মের মাস থেকেই খ্রিষ্টাব্দের গণনা শুরু করেছিল। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের মাস থেকে সূচনা করা হলে বাহ্যত খ্রিষ্টানদের অনুসরণ ও সাদৃশ্যতা হয়ে যায়, যা মুসলমানদের জন্য পরিত্যাজ্য। এ সম্পর্কে রাসূলের (সা.) বাণী- ‘তোমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বিরোধিতা করো’ (বুখারি ও আবু দাউদ শরিফ)।

অপর দিকে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওফাত দিবসের মাস থেকেও গণনা শুরু করা যাবে না, কারণ এতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যু ব্যথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। পাশাপাশি অজ্ঞ যুগের মৃত্যুও শোক পালনের ইসলামবিরোধী একটি কুপ্রথারই পুনরুজ্জীবন ঘটবে। হজরত ওমর (রা.) এর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যের সঙ্গে হজরত ওসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.) একবাক্যে সহমত পোষণ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হজরত ওমর ফারুক (রা.) হিজরতের বছর থেকেই ইসলামি দিনপঞ্জি গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জমাদিউল উলা ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে।

মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সনের প্রথম মাস হলো মহররম। মহররম একটি তাৎপর্যমণ্ডিত ও বরকতময় মাস। মুসলিম ইতিহাসে এ মাসটি বিভিন্ন কারণে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কোরআনুল কারিমে এ মাসটিকে ‘শাহরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাস বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘চারটি মাস রয়েছে যেগুলো সম্মানিত মাস। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মহররম (সূরা তাওবাহ-৩৬)। আর এ মাসেই রয়েছে ফজিলতপূর্ণ ‘আশুরা’। মহররমের দশম তারিখে ঐতিহাসিক ‘কারবালা’ সংঘটিত হয়েছিল। এ ছাড়া বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও এই দিনে আরো অনেক ঘটনা ঘটবে।

হিজরি সন মুসলমানদের সন। মুসলমানদের উচিত এর অনুসরণ করা। এ ক্ষেত্রে উদাসীনতা কাম্য নয়। ইসলামি ফিকাহবিদরা চান্দ্রবর্ষের হিসাব রাখাকে মুসলমানদের জন্য ফরজে কিফায়া বলেছেন। অর্থাৎ কেউ কেউ এর খবরাখবর রাখলে সবার দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু সবাই যদি এ বিষয়ে উদাসীনতা দেখায় তাহলে প্রত্যেকে গুনাহগার হবে।

চান্দ্রমাসের হিসাবের অনুসরণ নবী (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নত। যাদের অনুসরণ আমাদের জন্য পুণ্যময় ও কল্যাণকর আমল। হজরত মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলেন, সৌর হিসাব রাখা ও ব্যবহার করা একেবারেই নাজায়েজ নয়। বরং এই এখতিয়ার থাকবে, কোনো ব্যক্তি নামাজ, রোজা, জাকাত, ইদ্দতের ক্ষেত্রে চান্দ্রবর্ষের হিসাব ব্যবহার করবে। কিন্তু ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে সৌর হিসাব ব্যবহার করবে। কিন্তু শর্ত হলো- সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের মধ্যে চান্দ্র হিসাবের প্রচলন থাকতে হবে। যাতে রমজান, হজ ইত্যাদি ইবাদতের হিসাব জানা থাকে। এমন যাতে না হয়, শুধু জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ছাড়া অন্য কোনো মাসই তার জানা নেই। আর হিজরি নববর্ষের মুসলমানরা কোনো আনন্দ উৎসব করবে না, তবে নবী (সা.) ও তাঁর সহকর্মীদের ত্যাগের কথা স্মরণ করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার শিক্ষা গ্রহণ করবে। হিজরি নববর্ষে মুসলমানদের নব উদ্যমে উদ্যমী হতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা নিয়ে এগোতে হবে।