মৃত্যুর সময় ও পরে মুমিনের আত্মার যা হয়

একদিন নবী করিম (সা.) এর একজন সাহাবি মারা গেলেন। রাসূল পাক (সা.) উনার জানাজা পড়ালেন। তারপর…

একদিন নবী করিম (সা.) এর একজন সাহাবি মারা গেলেন। রাসূল পাক (সা.) উনার জানাজা পড়ালেন। তারপর একদল সাহাবি মৃতদেহ কবর দেওয়ার জন্য কবরস্থানে নিয়ে আসলেন। সবার সঙ্গে আমাদের নবী করিম (সা.)-ও হেঁটে হেঁটে আসলেন।

দুই জন সাহাবী কবর খুঁড়তে শুরু করলেন।
সবাই মৃত দেহকে ঘিরে বসে আছেন।
কবর খনন শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন।
সবাই চুপচাপ, নীরব ও শান্ত একটি পরিস্থিতি।

নবীজি (সা.) গভীর মনোযোগ দিয়ে কবর খোঁড়া দেখছিলেন একটু পর সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,  তোমরা কি জানো, মানুষ মারা যাওয়ার পর, তার আত্মার কি হয়?

সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে নবীজি (সা.)-কে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমাদেরকে বলুন।

নবীজি (সা.) একটু চুপ করে থাকলেন। সবাই উনার কাছে এসে ঘিরে বসলেন। মৃত্যুর পর আত্মার কি হয়, এই তথ্য তাদের জানা ছিল না। আজ সেটা নবীজির (সা.) মুখে শুনবেন। কত বড় সৌভাগ্য। শুনার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে নবীজির (সা.) কাছে এসে বসলেন।

তিনি একবার কবরের দিকে তাকিয়ে মাথাটা তুলে আকাশের দিকে তাকালেন, তারপর; তিনি গল্পের মতো করে বলতে শুরু করলেন।

‘শুনো, যখন মানুষ একেবারেই মৃত্যু শয্যায়, তখন সে মৃত্যুর ফেরেস্তাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু যে বিশ্বাসী ও ভালো মানুষ তাকে মৃত্যুর ফেরেস্তা হাসি মুখে সালাম দেন। তাকে অভয় দেন এবং মাথার পাশে এসে ধীরে ও যত্ন করে বসেন। তারপর মৃত প্রায় মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘হে পবিত্র আত্মা! তুমি তোমার পালনকর্তার ক্ষমা ও ভালোবাসা গ্রহণ করো এবং এই দেহ থেকে বের হয়ে আসো।’

মুমিনের আত্মা যখন বের হয়ে আসে তখন সে কোনো ধরণের ব্যথা ও বেদনা অনুভব করে না।

নবী করিম (সা.) আরো একটু ভালো করে উদাহরণ দিয়ে বললেন, ‘মনে করো একটা পানির জগ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর তা থেকে এক ফোঁটা পানি যেমন নিঃশব্দে ওপর থেকে নিচে নেমে আসে ঠিক তেমনি নীরবে ও কষ্ট ছাড়াই আত্মাটি তার দেহ থেকে বের হয়ে আসে। সেই সময় দুইজন অন্য ফেরেস্তা বেহেস্ত থেকে খুব সুগন্ধি মাখানো একটা নরম সুতার সাদা চাদর নিয়ে আসেন এবং তারা আত্মাটিকে সেই চাদরে আবৃত করে আকাশের দিকে নিয়ে যান।

তারা যখন আকাশে পৌঁছেন তখন অন্য ফেরেস্তারা সেই আত্মাটিকে দেখার জন্য এগিয়ে আসেন। কাছে এসে সবাই বলেন, সুবহানাল্লাহ! কত সুন্দর আত্মা, কি সুন্দর তার ঘ্রান!

তারপর সবাই জানতে চান, এই আত্মাটি কার?

উত্তরে আত্মা বহনকারী ফেরেস্তারা বলেন, উনি হলেন, ‘ফুলান ইবনে ফুলান।’ (নবী (সা.) আরবিতে বলেছেন, বাংলায় হলো, ‘অমুকের সন্তান অমুক’)।

বাকি ফেরেস্তাগন তখন আত্মাটিকে সালাম দেয়, তারপর আবার জিজ্ঞেস করে, উনি কি করেছেন? উনার আত্মায় এতো সুঘ্রাণ কেন?

আত্মা বহন কারী ফেরেস্তা গন তখন বলেন, আমরা শুনেছি মানুষজন নিচে বলা-বলি করছে, উনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন, আল্লাহর ভালো বান্দা, অনেক দয়ালু, মানুষের অনেক উপকার করেছেন।

এতটুকু বলার পর নবী (সা.) একটু থামলেন।

তারপর সবার দিকে ভালো করে দৃষ্টি দিয়ে, উনার (সা.) কণ্ঠটা একটু বাড়িয়ে বললেন, এই কারণেই বলছি, সাবধান! তোমরা কিন্তু মানুষের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করবে না।

তুমি মারা যাওয়ার পর মানুষ তোমার সম্পর্কে যা যা বলবে, এই আত্মা বহনকারী ফেরেস্তারাও আকাশে গিয়ে ঠিক একই কথা অন্যদেরকে বলবে।

এই কথা বলে তিনি (সা.) আবার একটু চুপ করলেন, কবরটার দিকে দৃষ্টি দিলেন।

আবার বলতে শুরু করলেন।

এই সময় মানুষ যখন পৃথিবীতে মৃত দেহকে কবর দেওয়ার জন্য গোসল দিয়ে প্রস্তুত করবে তখন আল্লাহ তায়ালা আত্মা বহনকারী ফেরেশতাদেরকে বলবেন, ‘যাও, এখন তোমরা আবার এই আত্মাকে তার শরীরে দিয়ে আসো, মানুষকে আমি মাটি থেকে বানিয়েছি, মাটির দেহেই তার আত্মাকে আবার রেখে আসো। সময় হলে তাকে আমি আবার পুনরায় জীবন দেবো।’

তারপর মৃতদেহকে কবরে রেখে যাওয়ার পর দুইজন ফেরেস্তা আসবেন। তাদের নাম মুনকার ও নাকির।
তারা মৃতের সৃষ্টিকর্তা, তার ধর্ম ও নবী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন।

মুনকার নাকির চলে যাওয়ার পর, আত্মাটি আবার অন্ধকার কবরে একাকী হয়ে যাবে। তখন সে এক ধরণের অজানা আশংকায় অপেক্ষা করবে। কোথায় আছে? কি করবে? এক অনিশ্চয়তা এসে তাকে ঘিরে ধরবে।

এমন সময় সে দেখবে, খুব সুন্দর একজন তার কবরে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

তাকে দেখার পর আত্মাটি ভীষণ মুগ্ধ হবেন। এতো মায়াবী ও সুন্দর তার চেহারা, সে জীবনে কোনদিন দেখেনি।

আত্মাটি তাকে দেখে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে?

সেই লোকটি বলবে, আমি তোমার জন্য অনেক বড় সু- সংবাদ নিয়ে এসেছি, তুমি দুনিয়ার পরীক্ষায় উর্তীর্ণ হয়েছো, তোমার জন্য আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের ব্যবস্থা করেছেন, তুমি কি সেটা একটু দেখতে চাও?

আত্মাটি ভীষণ খুশি হয়ে বলবে, অবশ্যই আমি দেখতে চাই, আমাকে একটু জান্নাত দেখাও।

লোকটি বলবে, তোমার ডান দিকে তাকাও।

আত্মাটি ডানে তাকিয়ে দেখবে কবরের দেয়ালটি সেখানে আর নেই। সেই দেয়ালের দরজা দিয়ে অনেক দূরে সুন্দর বেহেস্ত দেখা যাচ্ছে।

বেহেস্তের এই রূপ দেখে আত্মাটি অনেক মুগ্ধ হবে ও প্রশান্তি লাভ করবে। এবং সেখানে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে লোকটিকে জিজ্ঞেস করবে, আমি সেখানে কখন যাবো? কিভাবে যাবো?

লোকটি মৃদু হেসে বলবেন, যখন সময় হবে, তখনই তুমি সেখানে যাবে ও থাকবে। আপাতত শেষ দিবস পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ভয় পেও না। আমি তোমার সঙ্গেই আছি। তোমাকে আমি সেইদিন পর্যন্ত সঙ্গ দেবো।

আত্মাটি তখন তাকে আবারো জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু তুমি কে?

তখন লোকটি বলবে, আমি তোমার এতদিনের আমল, পৃথিবীতে তোমার সব ভালো কাজের, তোমার সব পুণ্যের রূপ আমি, আজ তুমি আমাকে একজন সঙ্গীর মতো করে দেখছ। আমাকে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই এখানে পাঠিয়েছেন।

এই কথা বলে, লোকটি আত্মাটির ওপর যত্ন করে হাত বুলিয়ে দেবেন এবং বলবেন, হে পবিত্র আত্মা! এখন তুমি শান্তিতে ঘুমাও। নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নাও।

এই কথা বলার পর, আত্মাটি এক নজরে বেহেস্তের দিকে তাকিয়ে থাকবে এবং একসময় এই তাকানো অবস্থায় গভীর প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বে।’

নবীজি (সা.) এতটুকু বলে আবার একটু থামলেন। সাহাবিরা তখন গায়ের কাপড় দিয়ে ভেজা চোখ মুছলেন।

(বুখারি ও মুসনাদের দুইটি হাদিস অবলম্বনে)

আল্লাহ আমাদের পবিত্র আত্মা হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।