দেশপ্রেম আর কুকুরের প্রভূভক্তি

আহ্‌সান কবীর || দিন বদল বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ দুপুর ০২:৩১, বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৯
ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

ওই ঘোরতর সংকটেও মনে মনে হিসাব কষে দেখলাম ‘জান বাঁচানো দৌড়’ দিয়ে বাঁচা যাবে না, কারণ নালায়েকটা বাড়াবাড়ি রকমের কাছে চলে এসেছে। কুকুরটা যদি হামলা করেই বসে তাহলে শারীরিক ক্ষতি ছাড়া অফিশিয়াল ক্ষতির মুখেও পড়তে হবে নির্ঘাৎ…

১৯৯৪ সালে কুয়েতে যখন আসি তখন শীতকাল। মরুভূমির প্রচণ্ড শীতের মোকাবেলা করতে করতে নতুন দেশের হালচাল বুঝে ওঠার ফুরসত পাচ্ছিলাম না। শুরুতে অনেক কিছুই তাজ্জব লাগত।

যেমন বাড়ি, অফিস-আদালতের সামনে পার্ক করা গাড়িগুলো থাকত স্টার্ট দেওয়া অবস্থায়। দেখা যেত ভেতরে কেউ নেই, গাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ, কিন্তু ইঞ্জিন চলছে।

প্রথমে নিজে নিজে এর একটা মজারু সমাধান বের করলাম। তা হলো, সাদ্দাম যদি আবার হামলা করে বসে তখন যাতে গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়েও দেরি না হয়ে যায় (সৌদি সীমান্তে পৌঁছাতে), তাই এ ব্যবস্থা। পরে জেনেছি প্রচণ্ড শীতে ইঞ্জিন চালু করতে অনেক সময় বেশ ঝামেলাই হয়। এই ভোগান্তি এড়াতে শীতকালে এরা স্টার্ট দেওয়া গাড়ি সচরাচর বন্ধ করে না। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি।

আমাদের কর্মক্ষেত্র ছিল কুয়েত এয়ার ফোর্সের একটা বিমান ঘাঁটিতে। ব্যারাক আর মূল এয়ারবেসের মাঝে কাঁটাতারের নিরাপত্তা বেষ্টনী । অনেক সময়ে বিকালে অতিরিক্ত ডিউটি পড়ে গেলে ‘শ্রোতা-আশকারি’ অর্থাৎ মিলিটারি পুলিশের চেকপোস্ট এড়িয়ে ব্যারাকের পাশেই কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে শর্টকাট মারতাম। কারণ চেকপোস্ট পার হয়ে ডিউটি স্পটে পৌঁছাতে গেলে কমপক্ষে এক-দেড় কিলোমিটার হাঁটাপথের ধাক্কা। তাই ধরা পড়লে বেতন-কর্তন এমনকি জেল-জরিমানার ঝুঁকি নিয়েও ওই শর্টকাট পথেই আমরা বিকালের ডিউটিতে আসা-যাওয়া করতাম।

তো কাঁটাতারের বেড়া টপকালেই সামনে পড়ত বিমান ঘাঁটির এসি মেকানিকদের অস্থায়ী বাসস্থান। এরা ছিল ভারতের কেরালার অধিবাসী। সবাই কমবেশি লেখাপড়া জানা, শিক্ষিত। দেখা হলে তাদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হতো আরবি, ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি ভাষার এক জম্পেশ মিশেল দিয়ে।

একদিন বিকেলে আমার ডিউটি পড়ল, সঙ্গে আরেকজন। জামা বা গায়ে কোনোরকম আঁচড় ছাড়াই কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে এসিওয়ালাদের ডেরার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই সামনে হাজির রুদ্রমূর্তির এক সারমেয়। তার ভয়ংকর তর্জন-গর্জনে আত্মারাম প্খাঁরচাছাড়া হওয়ার জোগাড়।


প্রতীকী চিত্র

ওই ঘোরতর সংকটেও মনে মনে হিসাব কষে দেখলাম ‘জান বাঁচানো দৌড়’ দিয়ে বাঁচা যাবে না, কারণ নালায়েকটা বাড়াবাড়ি রকমের কাছে চলে এসেছে। কুকুরটা যদি হামলা করেই বসে তাহলে শারীরিক ক্ষতি ছাড়া অফিশিয়াল ক্ষতির মুখেও পড়তে হবে নির্ঘাৎ। এখান থেকে আহত হয়ে হাসপাতালে গেলে অবৈধভাবে বেড়া টপকানোর খবর কর্তৃপক্ষ জেনে যাবে। ফলাফল-বেতন কর্তন এবং সম্ভবত হাসপাতাল থেকেই সরাসরি শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ জেল । কমপক্ষে সাত দিনের!

কুকুরজাত উভয় সংকটে যখন চোখে অন্ধকার দেখছি, আতঙ্কে কলিজা শুকিয়ে রীতিমতো পদ্মার চর, সে সময়ে এসিওয়ালাদের ঘর থেকে দেবদূতের মতো বেরিয়ে এলো আমাদের পরিচিত এসি মেকানিক গঞ্জালেস। মুহূর্তেই পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে কুকুর সামলানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ও। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার মতো ওই পাগলা কুত্তা কিছুতেই তার 'সরকার' তথা মালিকের বশ মানছিল না।

একপর্যায়ে নিরুপায় হয়ে গঞ্জালেস হাতে একটা স্টিলের পাইপ তুলে নিয়ে কুকুরটাকে লাগাল মোহাম্মদ রফিক স্টাইলি ছক্কার এক পিটুনি। এবার যেমন কুকুর তেমন মুগুরের সার্থক সমীকরণে সারমেয় প্রবর 'শান্তিচুক্তি' মনে হয় মেনে নিল। কিন্তু তারপরেও দূরে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে গরর গরব রবে অকারণ রাগ ঝাড়তে লাগল।

ওদিকে আকস্মিক সংকট কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি গঞ্জালেসকে তার ‘সৎ কাজের পুরস্কার (!)’ দিতে তৎপর হয়ে উঠলাম

...এই কুত্তা কিসকা হ্যায়?

ভাইসাব ইয়ে কাল্ফ (কুকুর) হামারা হ্যায়। ইট বিলংস টু আস। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উত্তর দেয় ও।

আমি আরো খেপে যাই অমন নিরীহ উত্তরে। তেজের সঙ্গে বলি,

তুম ইসকো পালতা হ্যায়? ইজ ইট ইউর পেট?


প্রতীকী চিত্র

আইওয়া! অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’। গঞ্জালেসের বিরক্ত ও গম্ভীর উত্তর। তবে তার আরবি জবাবে আমি আরো খেপে যাই। অনেক কষ্টে পুরো আরবিতে (তাও টুটা-ফাটা) ঝাড়ি মারি তাকে- লেশ হাজা কাল্‌ফ লা ইসমা ইনতা কালাম? অর্থাৎ (তোমার পোষা) এই কুকুর তোমার অর্ডার শোনে না কেন?

এবার গঞ্জালেস তার ক্ষোভ-অভিমান ভুলে তরল কণ্ঠে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে যা বলে তার সহজ বাংলা হলো- আরে ভাই, এই দেশের, এই মাটির মানুষই তো বাফাদার ( বিশ্বস্ত) না, সেখানে এখানকার কুকুর বিশ্বস্ত হয় কী করে? (কুকুরের প্রভূভক্তির ফিরিস্তি কে না জানে। অথচ কিছুক্ষণ আগে এই কুকুরটাকে বশে আনতে গঞ্জালেসকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে ।)

ওদিকে কেরালাবাসী খ্রিস্টান গঞ্জালেস বলতে থাকে, জানোই তো, সাদ্দাম যখন কুয়েত হামলা করে তখন এই দেশের রাজা- বাদশা থেকে নিয়ে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বাসিন্দাদের বিরাট এক অংশ বউ-বাচ্চা, বাড়ি-ঘর,নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে দৌড়ে পালিয়েছিল সীমান্তের ওপারে। কোনো প্রতিরোধই করে নাই। সুতরাং শুধু শুধু অবিশ্বস্ততার জন্য এই কুকুরকে দোষ দিয়ে লাভ কী? ও তো ওর মনিবদের চরিত্রই পেয়েছে। আমরা তো হলাম সব আজনবি অর্থাৎ বিদেশি। আমাদের কথা থোড়াই কেয়ার করবে সে!

আমি চুপ হয়ে গেলাম। গঞ্জালেস যা বলেছে তা দুই শ পার্সেন্ট হককথা । অল্পসংখ্যক কুয়েতি ছাড়া বাকি সবই এক কিসিমের, এতে কারো সন্দেহ নাই। সঙ্গে সঙ্গে ৭১ এর বর্গী পাকিস্তানিদের বর্বর হামলার মুখেও অকুতোভয় বাঙালির ইস্পাতকঠিন প্রতিরোধ সংগ্রামের কথা ভেবে গর্বে আমার বুকটা ভরে উঠল ।

মনে হলো গঞ্জালেস আমার মনের ভাব ধরতে পেরেছে । আমার দিকে তাকিয়ে এবার নিঃশব্দে মিটিমিটি হাসতে লাগল। অনুভূতি বলল, সে আমাকে ওই নীরব হাসি দিয়ে বাঙালি জাতির বীরত্বের জন্য ‘সশ্রদ্ধ সালাম’ করছে । আর একই সঙ্গে এই কুয়েতের মাটিতে দাঁড়িয়েই নিজ মাতৃভূমির প্রতি বে-বাফাদারির' জন্য অহংকারী কুয়েতিদের বিদ্রূপ ও উপহাস করছে।

দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলনে নিঃশঙ্কচিত্তে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়া অযুত-নিযুত জানা-অজানা মুক্তিসেনানীদের উদ্দেশ্যে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুরণিত হয়ে উঠল- ‘সালাম সালাম হাজার সালাম!’ আবেগে চোখ ভিজে এলো। অসম্ভব ভালোলাগার এক পুলকে ঘাড়ের-গর্দানের রোমগুলো সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল। এ অনুভূতি আমার সম্পূর্ণ নতুন।

[email protected]

দিনবদলবিডি/Rony

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়